করোনা পরিস্থিতির কারণে এ বছর প্রায় সাত মাস বন্ধ ছিল থিয়েটার কার্যক্রম ও প্রদর্শনী। এরপর করোনাকালকে উপেক্ষা করেই শুরু হয় মঞ্চনাটক প্রদর্শনী। মঞ্চে আসে কিছু নতুন প্রযোজনা। সম্প্রতি প্রাঙ্গণেমোর ছেড়ে চলে যান ২৭ জন সদস্য! বছর শেষে থিয়েটার অঙ্গনের সার্বিক বিষয় নিয়ে লিখেছেন- পান্থ আফজাল
‘লালজমিন’ দিয়ে মঞ্চ সরব
শূন্যন রেপাটরির উদ্যোগে এ বছরের ২৮ আগস্ট মোমেনা চৌধুরীর ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রদর্শিত হয় ‘লালজমিন’। এরপর আস্তে আস্তে থিয়েটারের সার্বিক পরিস্থিতি শিথিল হয়। ২৩ অক্টোবর থেকে খুলে যায় শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার তিনটি মিলনায়তন। শুরু হয় নতুন প্রযোজনা মঞ্চায়ন।
প্রাচ্যনাটের ‘মহলা মগন’ নাট্যোৎসব
নাট্যদল প্রাচ্যনাট তাদের রিহার্সেল ফ্লোরে এ বছর প্রদর্শনী করে ‘মহলা মগন’ নাট্য উৎসবের। এরপর নাট্য প্রদর্শনী করতে অনেকেই আগ্রহ প্রকাশ করেন। তবে দ্বিধা আর সিদ্ধান্তের দোলাচলে চলছিল নাট্যাঙ্গন। তবে স্বাস্থ্যবিধি শর্তারোপ দিয়ে সরকার ধীরে ধীরে সব খুলে দেয়। একেক করে খুলে যায় নাট্য প্রদর্শনীর মঞ্চ। নতুন প্রযোজনা হাতে নেওয়া দলগুলো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। নতুন নাটক মঞ্চায়নের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে তারা।
২২০ দিন পর চালু শিল্পকলা একাডেমি
নাট্যাঙ্গনের মানুষের দাবির মুখে প্রায় ২২০ দিন পর চালু হয় শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার তিনটি মিলনায়তন। ২৩ অক্টোবর (শুক্রবার) নাট্য প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে মিলনায়তনগুলো চালু হয়। এর সঙ্গে বাড়তি আনন্দ হিসেবে যোগ হয় নাটকের দলগুলোর বিনাভাড়ায় একাডেমির মিলনায়তনগুলো ব্যবহারের সুযোগ। তবে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় শর্ত বেঁধে দেয় যে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে অর্ধেক আসন ফাঁকা রেখে নাটকের মঞ্চায়ন করতে হবে এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্র ও শনিবার এবং সরকারি ছুটির দিন ছাড়া অন্যান্য দিন মিলনায়তন বরাদ্দ দেওয়া হবে না। এরপর মন্ত্রণালয়ের শর্ত মাথায় রেখে স্বাস্থ্যবিধি মেনে অর্ধেক আসন ফাঁকা রেখে নাটক মঞ্চায়নের ব্যাপারে সম্মতি প্রকাশ করে নাটকের বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন ও এর অধিভুক্ত বিভিন্ন নাটকের দল। জাতীয় নাট্যশালার মিলনায়তনগুলোর পাশাপাশি সংগীত ও নৃত্যকলা কেন্দ্র মিলনায়তন ও চিত্রশালা মিলনায়তনও খুলে দেওয়া হয়।
মঞ্চে নতুন প্রযোজনা
২৩ অক্টোবর শুক্রবার সন্ধ্যায় একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তনে মঞ্চায়িত হয় পালাকারের নাটক ‘উজানে মৃত্যু’। অন্যদিকে একই সময় পরীক্ষণ থিয়েটার হলে প্রদর্শিত হয় জাগরণী থিয়েটার প্রযোজিত নাটক ‘রাজার চিঠি’। স্টুডিও থিয়েটার হলে অনুষ্ঠিত হয় খেয়ালি নাট্যগোষ্ঠীর দুই দিনব্যাপী স্মরণানুষ্ঠান। পরদিন দলটি তাদের নিজস্ব প্রযোজনার নাটক ‘যুদ্ধ যুদ্ধ’, মৈত্রী থিয়েটারের ‘চা অথবা কফি’, উৎস নাট্যদলের ‘পতাকায় বঙ্গবন্ধু’ এই তিনটি নাটক মঞ্চায়ন করে। ওইদিন সন্ধ্যায় মহিলা সমিতির ড. নীলিমা ইব্রাহিম মিলনায়তনে প্রদর্শিত হয় শৌখিন থিয়েটারের ‘ধূম্রজ্বালা’ নাটকের উদ্বোধনী মঞ্চায়ন। অপূর্ব কুমার কুন্ডু রচিত এই নাটকটির নির্দেশনায় ছিলেন হামিদুর রহমান পাপ্পু। পদাতিক ও ঢাকা পদাতিকের প্রযোজনায় দুটি নাটকও মঞ্চায়ন হয়। ঢাকার মঞ্চ নতুন করে সচল হয় প্রতি শুক্রবার। সে কারণে ঢাকা থিয়েটারের একটি নতুন প্রযোজনা মঞ্চায়িত হয়। এটি ঢাকা থিয়েটারের ৪৯তম প্রযোজনা। সুপরিচিত নাট্যকার ও নির্দেশক আনন জামানের লেখা ও জনপ্রিয় অভিনেতা-নির্দেশক শহীদুজ্জামান সেলিমের নির্দেশনায় ঢাকা থিয়েটারের নতুন প্রযোজনা ‘একটি লৌকিক অথবা অলৌকিক স্টিমার’। এই প্রযোজনাটির আবার মঞ্চ পরিকল্পনা করেছেন দেশের নামকরা অভিনেতা আফজাল হোসেন। আবহ সংগীতে ‘জলের গান’খ্যাত সংগীত তারকা রাহুল আনন্দ। পোশাক পরিকল্পনায় জনপ্রিয় অভিনেত্রী রোজী সিদ্দিকী। আলো পরিকল্পনায় আছেন ওয়াসিম আহমেদ। এই নাটকটি মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন পর নাট্যজগতের দুই তারকা সেলিম-রোজী আবার মঞ্চে ফিরছেন। ফিরছেন আফজাল হোসেনও। পুরান ঢাকার বাফা (ওয়াইজঘাট)-এ বাতিঘর থিয়েটার পথনাটক ‘গুজবাষ্প’ প্রদর্শন করে। বাতিঘরের সদস্যদের অংশগ্রহণে এটির নির্দেশনা দেন দলটির দলীয় প্রধান সঞ্জয় সরকার মুক্তনীল। এটি তারই রচনা। এ বছর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় মঞ্চস্থ হয় প্রাচ্যনাটের নাটক ‘পুলসিরাত’। ফিলিস্তিনি লেখক ঘাসান কানাফানির উপন্যাস ‘মেন ইন দ্য সান’ অবলম্বনে এটি অনুবাদ করেছেন মাসুমুল আলম। নাট্যরূপ দিয়েছেন মনিরুল ইসলাম রুবেল এবং নির্দেশনা দিয়েছেন কাজী তৌফিকুল ইসলাম ইমন। মহাকাল নাট্য সম্প্রদায় আয়োজিত ‘বাংলা নাট্য উৎসব’-এ স্বাস্থ্যবিধি মেনে নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। এতে অভিনয় করবেন আজাদ আবুল কালাম, শাহরিয়ার সজীব, মনিরুল ইসলাম রুবেল, সাইফুল ইসলাম জার্নাল, চেতনা রহমান ভাষা প্রমুখ। সেট ডিজাইন করেছেন শাহীনুর রহমান, সংগীত পরিকল্পনায় নীল কামরুল, আলোক পরিকল্পনায় বাবর খাদেম। নাটকের দল বটতলার নিজস্ব প্রযোজনা ‘সোহোতে মাস্ক’। অনুরাগ থিয়েটারের ‘অবজেকশন ওভাররুলড’। নাটকটির রচয়িতা ও নির্দেশক মাহবুব আলম। বিভিন্ন চরিত্রে আছেন শামছি সায়কা (পদাতিক), মেহমুদ লেনিন (থিয়েটার আর্ট ইউনিট), মীর মিজানুর রহমান, নিজাম নূর, সাহাদাত হোসেন সাঈদ, জ্যোৎস্না আক্তার, জাহিদ হাসান আশিক প্রমুখ। নৈবেদ্য থিয়েটারের পঞ্চম প্রযোজনা ‘প্রত্যাবৃতা’। বিদেশি নাট্যকার আন্তন চেখভের দুটি গল্প অবলম্বনে এটির নাট্যরূপ ও রূপান্তর করেছেন বিবি কানিজ, ডিজাইন, প্রয়োগ ভাবনা ও নির্দেশনায় রয়েছেন রাজীব রেজা। ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় প্রাঙ্গণেমোর মঞ্চে আনে নতুন নাটক ‘মেজর’। যেখানে অভিনয় করেন নূনা আফরোজ, অনন্ত হীরা, রামিজ রাজু প্রমুখ। নাটকটির রচনা ও নির্দেশনায় আছেন অনন্ত হীরা। ২০২১ সালের শুরুতেই মঞ্চে আসছে তাদের আরেকটি নতুন নাটক ‘পতাকা পাগল’। অনন্ত হীরা রচিত এই নাটকটির নির্দেশনায় থাকবেন নুনা আফরোজ। এ বছর ঢাকা পদাতিক, পদাতিক নাট্য সংসদ, মহাকাল, বাতিঘর নাট্যদল, বাংলাদেশ থিয়েটার, জেনেসিস থিয়েটারসহ বেশ কয়েকটি দল নতুন প্রযোজনা নিয়ে মহড়া কক্ষে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
প্রাঙ্গণেমোর ছেড়ে যান ২৭ জন
বাংলাদেশের প্রথম সারির নাট্যদল প্রাঙ্গণেমোর থেকে একই সঙ্গে দলের অর্ধেকেরও বেশি নাট্যকর্মী দলত্যাগ করেন এ বছরের শেষে। নাট্যদলের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্যসহ মোট ২৭ জন নাট্যকর্মী প্রাঙ্গণেমোর দলপ্রধান বরাবর ১২ ডিসেম্বর দলত্যাগের চিঠি দেন। দলত্যাগ প্রসঙ্গে দলের স্থায়ী সদস্য মাইনুল তাওহীদ বলেন, ‘দীর্ঘদিনের ক্রমাগত অনিয়ম আর ভাবনাগত অমিলের কারণে শেষ পর্যন্ত আর এই দলে থাকা সম্ভব হলো না। যেমন- আমি নিজে দলের অর্থের দায়িত্বে থাকলেও আমাকে পাশ কাটিয়ে অর্থের সব হিসাব দলপ্রধান অনন্ত হীরা নিজে কুক্ষিগত করে রেখেছিলেন।’ দলপ্রধানের আর্থিক অস্বচ্ছতা, অসততা, স্বেচ্ছাচারিতা ও নানাবিধ অনিয়ম-ভাবনাগত মতপার্থক্যের কারণে ছাড়ছেন বলে জানান তারা। তবে দলটির অন্যতম সদস্য নূনা আফরোজ বলেন, ‘দলত্যাগ করা প্রত্যেক সদস্যের প্রতি আমার অফুরন্ত শুভকামনা। চাই, তারা সৃজনে থাকুক। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের একটি উক্তি আছে ‘শিল্পের সঙ্গে প্রতারণা জীবনে ছায়া ফেলে’। তাই আমি চাই, তারা প্রত্যেকে অন্তত সৃজনে থাকুক, শিল্পে থাকুক।’
বছর শেষে সেরা চমক ‘৪.৪৮ মন্ত্রাস’
ঢাকার মঞ্চে সৈয়দ জামিল আহমেদের নাটক মানেই দর্শকের তুমুল আগ্রহ। ‘চাকা’, ‘বিষাদ সিন্ধু’, ‘বেহুলার ভাসান’, ‘সঙভঙচঙ’ নাটকগুলো নির্দেশনা দিয়ে দারুণ প্রশংসিত হয়েছেন তিনি। এরপর বেশ কিছু দিন বিরতি দিয়ে ‘রিজওয়ান’, ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ নামের দুটি নাটক নিয়ে হাজির হন। বলার অপেক্ষা রাখে না, সেই নাটক দুটিও দর্শক মাতিয়েছে। রীতিমতো আলোচনার ঝড় তোলে দুটি নাটক। সেই ধারাবাহিকতায় এবার এই নাট্যনির্দেশকের হাত ধরে মঞ্চে আসছে ‘৪.৪৮ মন্ত্রাস’। আজ থেকে শুরু হয়ে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিন সন্ধ্যায় রাজধানীর বেইলি রোডে নাটক সরণির বাংলাদেশ মহিলা সমিতি মিলনায়তনে মঞ্চায়িত হবে নাটকটি। পরিকল্পনা ও নির্দেশনা দিয়েছেন সৈয়দ জামিল আহমেদ। প্রযোজনা করেছে স্পর্ধা। প্রযোজনা সংগঠন থেকে বলা হয়েছে আমেরিকান সারাহ কেইনের ‘৪.৪৮ সাইকোসিস’ থেকে ‘৪.৪৮ মন্ত্রাস’ নাটকটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন শাহমান মাইশান এবং শরীফ সিরাজ। গত মার্চ মাসে নাটকটির মহড়া শুরু হলেও করোনা পরিস্থিতির কারণে উদ্বোধনী মঞ্চায়ন পিছিয়ে যায়। নাটকের বিষয়বস্তু হলো এক তরুণ শিল্পীর মনস্তত্ত্বে বিষণœতার জন্ম। কারণ তিনি সমাজে ব্যাপকভাবে সহিংসতার সাক্ষী। যেমন- ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন, খুন, আমৃত্যু নির্যাতন, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা এবং সমাজে বিশৃঙ্খল অনিশ্চয়তা।