লালনের ভাববানী ও সুরের প্রবাহমান স্রোতে ঢেউ খেলেছিলো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। নিমগ্ন চিত্তে সাঁইজির দার্শনিক ভাবনার অমূল্য বাণী হৃদয়ে ধারণ করে পিন পতন নীরবতায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সেজেছিলো ভিন্ন রূপে। শিল্পীদের পরিবেশনার সময় একাগ্র চিত্তে পিন পতন নীরবতায় সুরের সমুদ্রে ডুব দেওয়া। এরপর শিল্পীর পরিবেশনা শেষে নীরবতা ভেঙ্গে মুহুর্মুহু করতালিতে শিল্পীর প্রতি আন্তরিক অভিনন্দন ও সেই সাথে "ওয়ান মোর ওয়ান মোর" ধবনিতে গানের আবেদন। আল্লাহ আল্লাহ বলরে মন, সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে, মিলন হবে কতদিনে, খাঁচার ভেতর অচিন পাখিসহ একের পর এক পরিবেশনায় সমগ্র সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও এর আশপাশে মূর্ত হয়ে উঠে লালন ফকির। অগণিত ভক্তদের পদচারণায় মুখরিত ছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। মঞ্চের শিল্পীদের সাথে জনপ্রিয় গানগুলোর সঙ্গে কণ্ঠ মেলান লালন ভক্ত অনুরাগীরা।
লালন সাঁইয়ের ১৩৫ তম তিরোধান দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে শনিবার রাতে এমন দৃশ্যকল্পই চিত্রিত ছিলো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে।
জাতীয় পর্যায়ে লালন সাঁইয়ের ১৩৫তম তিরোধান দিবস উপলক্ষে প্রথমবারের মতো এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
লালন সাঁইয়ের উপর নির্মিত ভিডিওচিত্র প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে সন্ধ্যায় শুরু হয় এই আয়োজন। এরপর ধারাবাহিক পরিবেশনায়
এ্যানি বৈরাগী ও সুখলাল রায় গেয়ে শোনান ‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে’, ‘আল্লাহ বলো মনরে পাখি’ এবং ‘যদি তরিতে বাসনা থাকে’। সূচনা শেলী পরিবেশন করেন ‘কি সন্ধানে যাই সেখানে মনের মানুষ যেখানে’, ‘আলিফ দিয়ে টোকা মারো’, ফাহমিদা আহমেদ শিফার কন্ঠে গীত হয় ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’ ও ‘আমার ঘরখানায় কে’। এরপর পরিবেশনা নিয়ে মঞ্চে উঠেন বাউলা ব্যান্ড। তারা বাউলা বন্ধনা দিয়ে শুরু করে একে একে গেয়ে শোনায় ‘প্রাণ গৌর এসে’, ‘দিলনা দিলনা’, ‘রবে না এ ধন’ ইত্যাদি গানগুলো। এরপর মঞ্চে উঠেন গানের দল টংয়ের গান। ধারাবাহিক পরিবেশনায় মঞ্চে আসেন পথিক নবী এন্ড টিম ক্রিয়েটিভ। ‘তিন পাগলের হলো মেলা’, ‘ধন্য ধন্য বলি তারে’, ‘আমি অপার হয়ে বসে আছি’সহ সাঁইজির বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় গান পরিবেশন করেন এই দলটি। অরূপ রাহী গেয়ে শোনায় ‘পাপ পূণ্যের কথা আমি কারে বা শুধাই’, ‘মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার’ ইত্যাদি। দলীয়ভাবে সমগীত পরিবেশন করে ‘আছে যার মনের মানুষ মনে তোলা’, ‘এমন মানব জনম আর কি হবে’, ‘গোষ্ঠে চলো হরি মুরারী’ প্রভৃতি।
সাঁইজির ভাবের ঢেউ কানায় কানায় পরিপূর্ণ উদ্যানে ছড়িয়ে দিয়ে অনুষ্ঠানে আরো সংগীত পরিবেশন করে নীরব অ্যান্ড বাউলস, দীনা মণ্ডল, মুজিব পরদেশী, কানিজ খন্দকার মিতু ও সাগর বাউল। এরপর মঞ্চে উঠেন বেঙ্গল সিম্ফনি। পরিবেশনায় ছিলেন আলেয়া বেগম, শিবলু, মাখন দেওয়ান মার্থা, টুনটুন বাউল। তারা পরিবেশন করেন ‘মিলন হবে কতো দিনে’, ‘মন তুই করলি রে কি ইতর পনা’, ‘তিন পাগলের হইলো মেলা’, ‘কানার হাট বাজার’ প্রভৃতিত গানসমূহ। সবশেষে সংগীত পরিবেশন করে লালন ব্যান্ড। তারা একে একে পরিবেশন করেন ‘জাত গেল’, ‘ক্ষ্যাপা’, ‘অপার হয়ে বসে আছি’, ‘সময় গেলে সাধন হবে না’, ‘গুরুর চরন’ ও ‘পাগল’।
এর আগে সংক্ষিপ্ত আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মফিদুর রহমান, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক তানজিম ইবনে ওয়াহাব বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তর-সংস্থার দায়িত্বশীল কর্মকর্তাগরা।
এদিকে, লালনের তিরোধান দিবস উপলক্ষে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ও কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় গত ১৭ অক্টোবর শুক্রবার থেকে কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার ছেউড়িয়ারস্থ লালন ধামে চলছে তিনদিনের লালন উৎসব। রবিবার শেষ হবে এই উৎসব।
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন