মঙ্গলবার, ৩ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা
‘কে হবে পরবর্তী টার্গেট’ শিরোনামে বার্তা

আতঙ্কে ব্লগার-প্রকাশকরা

নিজস্ব প্রতিবেদক

অগ্রিম তালিকা প্রকাশ করে একের পর এক ঘরে বা কার্যালয়ে ঢুকে কুপিয়ে খুনের ঘটনায় আতঙ্ক বোধ করছেন দেশের মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারী জনগোষ্ঠী। এর মধ্যে ব্লগার বা ব্লগারদের বইয়ের প্রকাশকরাই শুধু নন, বিভিন্ন সময়ে মৌলবাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়রাও ভুগছেন নিরাপত্তাহীনতায়। কেউ কেউ ইতিমধ্যেই মোবাইল ফোনের মেসেজে বা অনলাইনে পেয়েছেন মৃত্যুর হুমকি। পরিবার ও স্বজনদের চাপে পড়ে ইতিমধ্যেই দেশ ছেড়েছেন অনেকে। আবার কেউ কেউ স্থায়ীভাবে বিদেশ যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অবশ্য বিদেশে গিয়েও হত্যার হুমকি দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ফলে দেশে ও বিদেশে অবস্থান করাদের বেশির ভাগই এখন চলাফেরাও সীমিত করে দিয়েছেন। বিদেশে থেকেও পরিবারের কথা ভেবে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে ভয় পাচ্ছেন অনেকে। কর্মক্ষেত্রে যাওয়া বন্ধ করতে হয়েছে দেশে থাকাদের মধ্যে কয়েকজনকে। এক প্রকাশক আগামী বইমেলায় বই প্রকাশ থেকে বিরত থাকবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। আবার ভাড়া বাড়িতে বসবাস করা সরকারি নিরাপত্তাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা পড়েছেন ভিন্ন ধরনের ভোগান্তিতে। নানা অজুহাত দেখিয়ে বাড়িওয়ালারা তাদের আর রাখতে চাচ্ছেন না। অন্যদিকে, ক্রমাগত জঙ্গি হামলার দায় স্বীকার করা জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলাম ‘কে হবে আমাদের পরবর্তী টার্গেট’ শিরোনামে বার্তা প্রচার করছে ইন্টারনেটে। অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ও ব্লগারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় এক বছর ধরেই একের পর এক হুমকি ও পুলিশের কাছে প্রয়োজনীয় সহায়তা না পাওয়ায় বিদেশ যাওয়ার দিকে ঝুঁকছেন তারা। বিশেষত পাড়ি দিচ্ছেন ইউরোপের দেশ জার্মানি, ফ্রান্স, নরওয়ে ও সুইডেনে। ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার শোভন হত্যার পর দুই দফায় আক্রমণের শিকার হন আলোচিত-সমালোচিত ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিন। গত বছরের শেষার্ধে তিনি স্থায়ীভাবে জার্মানি চলে যান। এরপর চলতি বছরের জুলাইয়ে জার্মানি যান হুমায়ুন আজাদের ছেলে ব্লগার অনন্য আজাদ। একই মাসে দেশ ছেড়ে নরওয়ে গেছেন ব্লগার সন্ন্যাসী রতন। তার আগে মে মাসে দেশ ছাড়েন ব্লগার ও লেখক সৈকত চৌধুরী। কাছাকাছি সময়ে দেশ ছেড়ে সুইডেন গেছেন ব্লগিংয়ের জন্য পুলিশি হয়রানির শিকার হওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও ব্লগার সুব্রত শুভ এবং ব্লগার ক্যামেলিয়া কামাল। গত সেপ্টেম্বরে ফ্রান্সে গেছেন অপর ব্লগার মনির। অক্টোবরের মাঝামাঝি জার্মানি গেছেন ব্লগার তন্ময় চক্রবর্তী। সর্বশেষ অক্টোবরের শেষে ঢাকা ছেড়ে অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ও গণজাগরণ মঞ্চ আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত শাম্মী হক। শাম্মী জানান, ‘সর্বশেষ দুই মাস পুলিশি নিরাপত্তায় ছিলাম। কিন্তু পুলিশি নিরাপত্তা নিয়ে স্বাভাবিক জীবন সম্ভব নয়। ছাড়তে হয়েছে পড়াশোনা, চাকরি এমনকি হোস্টেলও। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েছি দেশ ছাড়তে। জানি না আর কবে দেশে ফিরতে পারব।’ ঢাকায় বসবাস করা গণজাগরণ মঞ্চের সক্রিয় কর্মী ও ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি খান আসাদুজ্জামান মাসুম রবিবার সন্ধ্যায় মোবাইল ফোনে প্রেরকের নম্বরবিহীন মেসেজে পেয়েছেন হত্যার হুমকি। শুধু এবারই নয়, এর আগেও তাকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। এ জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে তাকে নিরাপত্তা দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। তবে সেই নিরাপত্তা দিচ্ছে শুধু তার বাসার এলাকার লালবাগ জোনের পুলিশ। কিন্তু দিনের বেশির ভাগ সময় শাহবাগ বা পল্টন এলাকায় থাকলেও এই জোনের পুলিশকে বারবার তাগাদা দিয়েও কোনো ব্যবস্থা নেওয়াতে পারেননি। আরেক ব্লগার অমি রহমান পিয়ালকেও নিরাপত্তার জন্য দেওয়া হয়েছে পুলিশ। কিন্তু এই পুলিশি নিরাপত্তা তার ব্যক্তিজীবনে সৃষ্টি করেছে নানান জটিলতা। ভাড়া বাসার মালিক তাকে বাধ্য করেছেন বাসা ছাড়তে। গতকাল ছিল পিয়ালের জন্মদিন। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, পিয়াল তার জন্মদিনের ফেসবুক স্ট্যাটাসে নিজেই লিখেছেন- ‘বহু দিন বাচলা পিয়াল, শুভ জন্মদিন’। খান আসাদুজ্জামান মাসুম ও অমি রহমান পিয়ালের সঙ্গে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনে সক্রিয় থাকা ব্লগার আরিফ জেবতিক অক্টোবরে শুরুতে গিয়েছেন লন্ডন। এখনো দেশে ফেরেননি। অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের একজন জানান, পরিবার থেকেই ভয়ের বিষয়টি বেশি আসছে। তবে মাঝে মাঝেই টার্গেটেড কিছু ব্লগারকে একাধিক ব্যক্তির অনুসরণের ঘটনাও ঘটছে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন ব্লগার হত্যা মামলার আসামিরাও জামিনে ছাড়া পেয়ে যাচ্ছেন। সর্বশেষ অনন্ত বিজয় দাস হত্যার আসামি ইদ্রিস আলী জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। আবার ব্লগার আযম খানের বাসায় জোর করে ঢুকতে গিয়েছিলেন তিন সন্দেহভাজন ব্যক্তি।  অন্যদিকে, শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরে গিয়ে খুন করার হুমকিও দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি জার্মান পুলিশের পক্ষ থেকে সেখানে থাকা দুই প্রবাসী ব্লগার ওমর ফারুক লুক্স এবং ফারজানা কবীর খান øিগ্ধাকে হত্যার পরিকল্পনার কথা জানানো হয়। আনসারুল্লাহ বাংলা টিম সদস্যরা এ ধরনের পরিকল্পনা করছে বলে ব্লগার লুক্স ও øিগ্ধাকে সতর্ক করে জার্মান পুলিশ। পুলিশের পক্ষ থেকে তাদের বাসা ও কর্মস্থল বদলেরও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সে দেশের নাগরিক এ দুই ব্লগারকে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা দিচ্ছে জার্মান পুলিশ। ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের সময় রাজীব হায়দার শোভনকে হত্যার মাধ্যমে শুরু হয় ব্লগার খুনের ঘটনা। এর পর একে একে পাঁচজন ব্লগারকে খুন করা হয়। সর্বশেষ শনিবার হত্যা করা হয় জাগৃতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফয়সাল আরেফিন দীপনকে। কুপিয়ে আহত করা হয় শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর আহমেদুর রশীদ টুটুল এবং লেখক ও ব্লগার রণদীপম বসু, তারেক রহিমকে। তারা ব্লগার অভিজিৎ রায়ের বই প্রকাশ করেছিলেন, এটাই তাদের অপরাধ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর