মঙ্গলবার, ২৯ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

আমলাদের কর্তৃত্বে উত্তাপ সংসদে

এমপিরা সচিবদের ওপরে, এটা খেয়াল রাখতে হবে : তোফায়েল । দেশ চালাচ্ছেন জগৎ শেঠরা, আমলারা : কাজী ফিরোজ রশীদ

নিজস্ব প্রতিবেদক

আমলাদের কর্তৃত্বে উত্তাপ সংসদে

আমলাদের কর্তৃত্ব নিয়ে সংসদে উত্তপ্ত আলোচনা হয়েছে। আমলাদের কঠোর সমালোচনা করেছেন সিনিয়র সংসদ সদস্যরা। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় জেলাওয়ারি স্বাস্থ্যসেবা ও সরকারি কার্যক্রম সমন্বয় করতে সচিবদের দায়িত্ব দেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তারা। সংসদ সদস্যরা বলেন, এটা একটা রাজনৈতিক সরকার। কিন্তু দেশ চালাচ্ছে আমলারা। এতে রাজনীতিবিদদের কর্তৃত্ব বা কাজ ম্লান হয়ে যায়। এ ছাড়া সংসদে কথা হয়েছে লকডাউনের সমন্বয়হীনতা, প্রশাসনের দুর্নীতি ও কানাডার বেগমপাড়ায় অর্থ পাচার নিয়ে। জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে গতকাল ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে সরকারি ও বিরোধী দলের সদস্যরা এসব কথা বলেন। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে এ সময় সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে উপস্থিত ছিলেন।

বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ও আওয়ামী লীগের সিনিয়র পার্লামেন্টারিয়ান তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘করোনাকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবকিছু দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করেছেন। আর যারা জাতীয় সংসদ সদস্য এখানে উপস্থিত তাদের এমন একজনও নেই যিনি নিজস্ব অর্থায়নে বা যে কোনোভাবে গরিব-দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়াননি। সবাই দাঁড়িয়েছেন। আমরাও দাঁড়িয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘এখন আমাদের জেলায় জেলায় দেওয়া হয়েছে প্রশাসনিক কর্মকর্তা। মানুষ মনে করে আমরা যা দিই এগুলো দেন প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। অথচ প্রশাসনিক কর্মকর্তারা কিন্তু দেননি। অনেকেই যাননি। আমার নিজের জেলা ভোলায় যাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তিনি এখন পর্যন্ত যাননি। এটা কিন্তু ঠিক নয়! এটা একটা রাজনৈতিক সরকার। রাজনীতিবিদদের যে একটা কর্তৃত্ব বা কাজ তা কিন্তু ম্লান হয়ে যায়।’

সাবেক মন্ত্রী তোফায়েল বলেন, ‘আমাদের পরিকল্পনামন্ত্রী বলেছেন ফেরাউনের সময়ও আমলা ছিল। তিনিও একজন আমলা ছিলেন। এসব কথাবার্তা মানুষ পছন্দ করে না। ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে (রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রম) এমপিরা সচিবদের ওপরে। বিষয়টি খেয়াল করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘জাতির পিতার হত্যার পর জিয়াউর রহমান বলেছিলেন আমি রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি কঠিন করে দেব। তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তা করেছিলেন। এটা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্য।’

তোফায়েল বলেন, ‘এটা রাজনৈতিক সরকার। যারা নির্বাচিত প্রতিনিধি তাদের জন্য নির্ধারিত স্থান যেখানে আছে সেখানে থাকা উচিত। আমাদের জেলায় একজন সচিব যাবেন। তাকে গ্রহণ করব, বরণ করে নেব তা ঠিক আছে। কিন্তু যারা এক দিনের জন্যও যান না তারাই দায়িত্বপ্রাপ্ত।’ নিজের মন্ত্রিত্বকালের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘আমরাও মন্ত্রী ছিলাম। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর আমি শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলাম। আমারও দায়িত্ব ছিল একটি জেলায়। তখন মন্ত্রীরা জেলার দায়িত্ব পালন করতেন। একটি জেলায় মন্ত্রীরা গেলে নেতা-কর্মীরা আসত। তাদের সঙ্গে কথাবার্তা হতো। আমরা গ্রামে-ইউনিয়নে সব জায়গায় যেতাম। কোথায় যেন সেই দিনগুলো হারিয়ে গেছে।’

পরে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘তোফায়েল আহমেদ যথার্থ বলেছেন। দেশে কোনো রাজনীতি নেই। রাজনীতিশূন্য। কোথাও রাজনীতি নেই। প্রতিটি জেলার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সচিবদের। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ডিসিদের সঙ্গে কথা বলেন। আর এমপি সাহেবরা দূরে বসে থাকেন। তারপর বলেন ডিসি সাব, আমি একটু কথা বলব প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। এই হচ্ছে রাজনীতিবিদদের অবস্থা। দেশ চালাচ্ছেন আমলারা। দেশ চালাচ্ছেন জগৎ শেঠরা। আমরা রাজনীতিবিদরা এখন তৃতীয় লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। এই হচ্ছে আমাদের দুর্ভাগ্য। অথচ এ দেশ স্বাধীন করেছেন রাজনীতিবিদেরা।’ তিনি অভিযোগ করেন, এখন রাজনীতিবিদদের চেয়ে আমলাদের বেশি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ডিসিদের সঙ্গে যখন কথা বলেন তখন এমপিদের কোনো দাম থাকে না। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু, পায়রা বন্দর, মেট্রোরেল যা-ই করা হোক রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ছাড়া জনগণ এর সুফল পাবে না। রাজনীতিবিদ ছাড়া এ প্রতিশ্রুতি থাকে না। অন্যরা বাতাস যেদিকে সেদিকে ছাতা ধরেন। জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় ছিল, সে তিক্ত অভিজ্ঞতা তাদের আছে।

কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘আওয়ামী লীগের বৃহস্পতি এখন তুঙ্গে। কারণ কোনো রাজনীতি নেই। রাজনীতির নামে এখন পালাগানের অনুষ্ঠান হয়। সন্ধ্যার সময় ওবায়দুল কাদের একদিকে পালাগান করেন, একটু পরই টেলিভিশনে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আরেকটা পালাগান করেন। আমরা রাজনীতিবিদরা ঘরে বসে টেলিভিশনে পালাগানের রাজনীতি দেখি। এ পালাগান চলছে ১০ বছর। রাজনীতিশূন্য, কোথাও রাজনীতি নেই।’

জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য রুস্তম আলী ফরাজী বলেন, ‘প্রশাসনের সর্বত্র ঘুষ, দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে। একজন বলেছেন ১ হাজারের ওপরে বেগমপাড়া রয়েছে কানাডায়। কারা করেছেন? তারা কি সব এমপি? নো। ম্যাক্সিমাম সরকারি কর্মকর্তা। কিছু ব্যবসায়ী। আর কিছু আমাদের নষ্ট রাজনীতিবিদ। এই অপদার্থ কিছু রাজনীতিকের কারণে সব রাজনীতির নামে চালানো হয়। রাজনীতিবিদ নন, সবচেয়ে বেশি হচ্ছেন আমলারা, সরকারি কর্মচারীরা। তারা দুর্নীতি করে আগে স্ত্রীর নামে বাড়ি কেনেন। ছেলেকে পাঠান। পরে নিজে যান। দুর্নীতি-লুটপাট করে ফাঁকে ফাঁকে ওখানে পাঠিয়ে দেন। এমন কোনো মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা ক্ষেত্র নেই যেখানে ঘুষ ছাড়া কেউ কোনো কাজ করাতে পারেন। আর কেউ পারলে তিনি ভাগ্যবান। ভূমি অফিসে গেলে এসি ল্যান্ডকে ঘুষ দেওয়া লাগবে। আরেক জায়গায় গেলে তহশিলদারকে ?ঘুষ দেওয়া লাগবে। একটু বড় কাজ হলে ইউএনওকে টাকা দেওয়া লাগবে। আরও বড় হলে ডিসিকে টাকা দেওয়া ছাড়া হবে না। থানায় তো দারোগা বাবুরা। আপনি মার খাবেন, আপনার লোক আহত হবে, নিহত হবে। এর পরও এফআইআর করতে গেলে আগে টাকা, তারপর কথা।’

জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, করোনা সংক্রমণ ইস্যু নিয়ে সরকারের মধ্যে অস্থিরতা কাজ করছে। লকডাউন-শাটডাউনসহ বারবার প্রজ্ঞাপন পরিবর্তনের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘সরকারের ভিতরে আমি অস্থিরতা লক্ষ্য করছি। গত কয়েক দিনে লকডাউন-শাটডাউন নিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি এবং তা ঘন ঘন সংশোধন। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে অদলবদল করা। এসব বক্তব্য-বিবৃতির মধ্য দিয়ে অস্থিরতাই প্রকাশ পাচ্ছে।’ গতকাল জাতীয় সংসদে পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে তিনি এ অভিযোগ করেন। সিলেট-২ (বিশ্বনাথ-ওসমানীনগর) আসনের সংসদ সদস্য গণফোরামের মোকাব্বির খান বলেন, স্বাধীনতার পর থেকেই দেখা যাচ্ছে কিছুসংখ্যক অসৎ আমলা, দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী ও অসৎ রাজনীতিকের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট সরকারের সব ভালো উদ্যোগ ব্যাহত করে দেয়। দুর্বৃত্তরা এখন আরও বেশি সর্বগ্রাসী হয়ে উঠেছে।

সর্বশেষ খবর