বৃহস্পতিবার, ২১ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

নাহিদের শরীরজুড়ে ক্ষত শুধুই আর্তনাদ পরিবারে

নিজস্ব প্রতিবেদক

নাহিদের শরীরজুড়ে ক্ষত শুধুই আর্তনাদ পরিবারে

প্রেমের সম্পর্কের এক বছর পর মাত্র ছয় মাস আগে ডালিয়াকে বিয়ে করে বাবা-মা, স্ত্রী ও দুই ভাইয়ের সংসারের হাল ধরেছিল রাজধানীর নিউমার্কেটে ব্যবসায়ী ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষে নিহত নাহিদ হোসেন। সংসার চালাতে বেছে নিয়েছিল কুরিয়ার সার্ভিসের ডেলিভারিম্যানের কাজ। কামরাঙ্গীরচরে ছোট্ট এক রুমের মধ্যে সাজিয়েছিল সুখের সংসার। কিন্তু তার অকাল মৃত্যুতে এখন দিশাহারা পরিবার। নববধূর হাতের মেহেদির রং এখনো মুছে যায়নি! কয়েকদিন আগে হাতে মেহেদি দিয়েছিলেন ডলি। সেখানে নাহিদের প্রতি তার ভালোবাসার কথা লেখা। সেই মেহেদির রং এখনো মুছে না গেলেও হারিয়ে গেছে প্রিয় মানুষটি।

শিক্ষার্থী-ব্যবসায়ী সংঘর্ষে নিহত নাহিদের সারা শরীরে মারধরের চিহ্ন পাওয়া গেছে। মরদেহের মাথার তালু থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত অসংখ্য জখম ছিল। গতকাল দুপুরে নাহিদের মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) মর্গে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। এরপর অ্যাম্বুলেন্সে করে তার মরদেহ কামরাঙ্গীরচরের বাসায় নেওয়া হয়। সেখানে নাহিদের বাবা নাদিম হোসেন জানান, নাহিদের মৃত্যর ঘটনায় মামলা করবেন না তিনি। বলেন, ‘আমরা অসহায় মানুষ। আমার ছেলে একটা ঘটনায় মারা গেছে। আমি চাই দোষীদের বিচার হোক। কিন্তু আমি মামলা করুম না। কোনো মামলায় যামু না। আমি গরিব মানুষ।’ কেউ কোনো প্রকার সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত কেউ আসে নাই, কিছু বলেও নাই। তবে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি আসছিলেন। তিনি নাম-ঠিকানা নিয়ে গেছেন। বলেছেন, দেখব কী করা যায়। এ ছাড়া কোনো সহায়তা কেউ করে নাই। কোনো বিচারের আশ্বাসও কেউ দেয় নাই।’ নাহিদের বাবা জানান, তিন ছেলের মধ্যে নাহিদ বড়। ওর বয়স ১৮। ছয় মাস আগে বিয়ে করেছে। নাহিদের বাবাব বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। অভাবের সংসারে টানাটানি লেগেই থাকে। পয়সার অভাবে ছেলেটাকে বেশিদূর পড়াতেও পারিনি। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত নাহিদ পড়েছে। এরপরেই তাকে কাজে দেই। ১০ বছর বয়সে ও নিউ সুপার মার্কেটে কাপড়ের দোকানে কাজ শুরু করে। অল্প বেতন পেত। তবুও তখন থেকেই আমার হাতে পয়সা দিত। গত চার বছর ধরে সে একটি প্রতিষ্ঠানে ডেলিভারিম্যানের কাজ করত।’

নাহিদ প্রতিদিন বাসা থেকে হেঁটে কাজে যেতেন বলে জানিয়েছেন তার মা নার্গিস বেগম। তিনি বলেন, ‘ওই এলাকায় সংঘর্ষ হচ্ছে খবর শুনে আমরা নাহিদকে কাজে যেতে না করেছিলাম। তবুও সে গেল। সন্ধ্যায় ওর বাবার ফোনে মেসেজ আসে যে নাহিদকে মেরেছে। কারা মেরেছে জানি না। কিন্তু ঘটনার তদন্ত করে দোষীদের শনাক্ত করে যেন আইনের আওতায় আনা হয়, আমরা তা-ই চাই। আমার ছেলের মতো ভালো ছেলে আর হয় না। সে কোনোদিন কারও সঙ্গে খারাপ আচরণ করেনি, মারপিট করেনি। সে সুস্থ দেহে কাজে বের হয়েছিল। এখন লাশ হয়ে ফিরেছে। আমি এ শোক সইবো কেমন করে?’

নাহিদের স্ত্রী ডলির কান্না কিছুতেই থামছে না। স্বামীর স্মৃতি বার বার স্মরণ করছেন, আর কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। পরিবারের সদস্যরা তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না। ডলি বলেন, ‘আমি কিছুটা অসুস্থ ছিলাম। নাহিদকে তাই কাজে যেতে মানা করেছিলাম।

কিন্তু সে তা মানেনি। সে বলে, করোনায় কাজ বন্ধ ছিল অনেকদিন। এই রোজার মাসে আর কাজ বন্ধ রাখা যাবে না। বস ফোন দিয়েছে। কাজে যেতে হবে, মার্কেটিং করতে হবে। এই বলে সে সকাল ১০টার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। তারপর আর আমার সঙ্গে তার কোনো কথা হয়নি। এরপর শুনি সে মারামারির মধ্যে পড়ে আহত হয়েছে। বসকে ফোন করে জানিয়েছে, আমি গোলাগুলির মধ্যে পড়ে গেছি, বের হতে পারছি না। ভালো একটা মানুষ বাড়ি থেকে বের হলো। এরপর কীভাবে কী হয়েছে জানি না’ এই বলে আবারও কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। কিছুক্ষণ আহাজারির পর ডলি বলেন, ‘আমি এ ঘটনার বিচার চাই, ক্ষতিপূরণ চাই।’

স্থানীয়রা জানান, নাহিদ খুব স্বাভাবিক জীবনযাপন করত। কাজে যেত আবার ফিরে আসত। নাহিদের বাবা-মা ঋণ নিয়ে তার নানির কাছ থেকে পাওয়া ছোট্ট একটু জায়গায় কোনোরকমে একটা বাড়ি করেছিলেন। বাড়িটা কোনোরকমে দাঁড়িয়ে আছে। নাহিদের বাবার টাকায় শোধ করা হতো সেই ঋণের টাকা। আর নাহিদের আয়েই চলত তার পরিবার।

পুলিশ জানিয়েছে, মঙ্গলবার কামরাঙ্গীরচরে বাসা থেকে বের হয়ে কর্মস্থলে যাচ্ছিলেন নাহিদ। এসময় সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে নিহত হন। ময়নাতদন্তে তার শরীরে বেশকিছু ক্ষত পাওয়া গেছে। এতে স্পষ্ট তার ওপর হামলা হয়েছিল।

গতকাল দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) মর্গে নিউমার্কেট এলাকায় ব্যবসায়ী ও ঢাকা কলেজের ছাত্রদের মধ্যে সংঘর্ষে নিহত নাহিদের মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। ময়নাতদন্ত করেন ঢামেকের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রভাষক ডা. ফারহানা ইয়াসমিন। এর আগে, নিউমার্কেট থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ইয়াসিন কবির মরদেহের সুরতহাল প্রস্তুত করেন। নাহিদের বাবা নাদিম মিয়া বলেন, নাহিদের মরদেহ কামরাঙ্গীরচরের বাসায় নেওয়া হয়। সেখানে জানাজা শেষে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।

সুরতহাল প্রতিবেদনে ঘটনার প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ উল্লেখ করে, নিউমার্কেট এলাকায় মঙ্গলবার দুপুরে ব্যবসায়ী ও ঢাকা কলেজের ছাত্রদের মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে গুরুতর আহত হয় নাহিদ। তখন পথচারিরা তাকে উদ্ধার করে ঢামেক হাপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করে এবং চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। নাহিদ এলিফ্যান্ট রোডে মাল্টিপ্ল্যান মার্কেটে ‘ডি লিংক’ নামে একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে কাজ করত। মঙ্গলবার কামরাঙ্গীরচরের বাসা থেকে কাজে যাওয়ার সময় নিউমার্কেটের সংঘর্ষে পড়ে সে।

সর্বশেষ খবর