গাজীপুরের একটি তৈরি পোশাক কারখানায় ১২ বছর কাটিয়েছিলেন শ্রমিক মো. জসিম উদ্দিন। হঠাৎ একদিন বিনা নোটিসে তাকে ছাঁটাই করা হয়। পাওনা বেতন, ওভারটাইম ও ক্ষতিপূরণসহ প্রায় ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা দাবি করে তিনি ২০১৯ সালে শ্রম আদালতে মামলা করেন। জসিমের মামলায় মোট ১৭ বার শুনানির তারিখ পড়েছে, কিন্তু বিচারক বদলি, কাগজপত্রের ঘাটতি কিংবা সময় সংকটে শুনানি হয়নি বেশির ভাগ দিনেই। এমন ঘটনা শুধু জসিমের একার নয়, দেশে শ্রম আদালতগুলোতে মামলা করা অধিকাংশ শ্রমিকের অভিজ্ঞতা প্রায় একই। ১৩ শ্রম আদালত ও একটি শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে ঝুলছে শ্রমিকদের প্রায় ২২ হাজার মামলা। শ্রম আইন অনুযায়ী এসব মামলা ৬০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তির বাধ্যবাধকতা থাকলেও বাস্তবে তা হচ্ছে না। ফলে বছরের পর বছর মামলার ভারে জর্জরিত শ্রমিকরা বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, আর এই দীর্ঘসূত্রতায় তৈরি হচ্ছে সীমাহীন ভোগান্তি। শ্রম আইনে বলা হয়েছে, আইন অনুযায়ী শ্রম আদালতকে ৬০ দিনের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করতে হবে। এ সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি না হলে উপযুক্ত কারণ ব্যাখ্যা করে আরও ৯০ দিন সময় দেওয়া যাবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এক যুগ আগের মামলাও আদালতে বিচারাধীন। আইনজীবীরা বলছেন, বিচার প্রক্রিয়ার ধীরগতির পেছনে রয়েছে পর্যাপ্ত বিচারক সংকট, অবকাঠামোগত ঘাটতি ও প্রশাসনিক জটিলতা। বর্তমানে দেশে শ্রম আদালতের সংখ্যা মাত্র ১৩টি। এই সংখ্যা সারা দেশের শ্রমিকদের মামলা নিষ্পত্তির জন্য অপ্রতুল। আর সারা দেশের শ্রমিকদের জন্য শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল মাত্র একটি। আদালত কম থাকায় বিচারকদের ওপর তৈরি হয় অতিরিক্ত মামলার চাপ। ফলে সময়মতো শুনানি ও রায় দেওয়া সম্ভব হয় না। শ্রম মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, গত ৩১ মার্চ পর্যন্ত দেশের ১৩টি শ্রম আদালত ও এক মাত্র শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে মোট বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ২১ হাজার ৮৯১টি। এর মধ্যে ১৩টি শ্রম আদালতে ২০ হাজার ৬৬৪টি এবং শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে ১ হাজার ২২৩টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন ১ হাজার ২২৩টির মধ্যে ৪১টি মামলা বর্তমানে হাই কোর্টের আদেশে স্থগিত রয়েছে। আইন অনুযায়ী ৬০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি না হওয়া মামলার সংখ্যা ১৩ হাজার ৪০২টি। শ্রম আদালতগুলোর তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ঢাকার তিনটি আদালতে যথাক্রমে ৪ হাজার ৬৭৬, ৩ হাজার ২৯৯ ও ২ হাজার ৬১৪; গাজীপুরে ৫ হাজার ৫২৮; নারায়ণগঞ্জে ২ হাজার ১৩৩; চট্টগ্রামের দুটি আদালতে যথাক্রমে ১ হাজার ৩৬৫ ও ৫৪৮; খুলনায় ৯১; কুমিল্লায় ১৫২; রাজশাহী ৭৩; বরিশালে ৬৬; রংপুরে ৭৫ এবং সিলেটে ৪৮টি মামলা বিচারাধীন। শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার মো. হেদায়েতুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমাদের কিছু সংকট রয়েছে। এরপরও মামলা নিষ্পত্তির হার আগের চেয়ে ভালো। আশা করি, লোকবলসহ সব ধরনের সংকট দূর করা হলে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা কমবে।
শ্রম আইন বিশেষজ্ঞ আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. সেলিম আহসান খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শ্রম আদালতে একজন শ্রমিক মামলা করার পর রায় পর্যন্ত যেতে তাকে অনেক ভোগান্তির শিকার হতে হয়। দিনের পর দিন আসতে হয় আদালতে। অধিকাংশ সময়ই মালিকপক্ষের অনীহার কারণে ভোগান্তিতে পড়েন শ্রমিক। তিনি বলেন, শ্রমিকদের ভোগান্তি কমাতে আদালতের সংখ্যা আরও বাড়ানো উচিত। একই সঙ্গে লোকবলসহ সব সংকট দূর করে শ্রমিকদের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা জরুরি।