বৃহস্পতিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা
সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল উদ্বোধন

বছরে ৩৫০ কোটি টাকা সাশ্রয়ের লক্ষ্য চিকিৎসায় নবদিগন্ত

নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশের প্রথম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল সকালে গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে এই হাসপাতালের উদ্বোধন ঘোষণা করেন তিনি। এ হাসপাতাল পুরোদমে চালু হলে বছরে অন্তত ৩৫০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের যারা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন তাদের শুধু চিকিৎসা দিলেই চলবে না। সঙ্গে সঙ্গে তাদের কিন্তু গবেষণা করাও জরুরি। কাজেই এই বিষয়ে আমি আপনাদের অনুরোধ করব যাতে আপনারা বিষয়টির প্রতি বিশেষভাবে নজর দেন। জাতির পিতা বলেছিলেন, ‘আপনারা ডাক্তার আপনাদের মন হতে হবে অনেক উদার, আপনাদের মন হতে হবে সেবার। আপনাদের কাছে কোনো বড় ছোট থাকবে না, আপনাদের কাছে থাকবে রোগ, কারও রোগ বেশি কারও কম। তাহলেই সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন হবে। আপনারা মানুষের সহযোগিতা পাবেন।

সরকার প্রধান বলেন, মাঠপর্যায়ে এখনো চিকিৎসক-নার্সের অভাব দেখা যায়। অনেকেই মাঠপর্যায়ে যেতে চান না। সবাইকে রাজধানীতেই থাকতে হবে এমন নয়। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি চিকিৎসকদের দেখার অনুরোধ করছি। যেন উপজেলা পর্যন্ত মানুষ চিকিৎসা সেবা পায়।

চিকিৎসকদের উদ্দেশ করে শেখ হাসিনা বলেন, মানুষের সেবা করুন, মানুষের পাশে দাঁড়ান। কারণ, আমার তো মনে হয় ওষুধের থেকেও একজন ডাক্তারের মুখের কথায় আশ্বস্ত হলে তার অর্ধেক রোগ ভালো হয়ে যায়। কাজেই এই আশ্বস্ত যেন রোগীরা পায় সেই ব্যাপারে প্রতিটা ডাক্তারকে আন্তরিকতার সঙ্গে দেখতে হবে। মনে রাখতে হবে, সাধারণ মানুষ সরকারি হাসপাতালে খুব অল্প খরচে চিকিৎসা নিতে আসেন। তারা যেন উন্নত চিকিৎসা পায়, সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে সরকারের নেওয়া উদ্যোগের সুফল পাচ্ছে দেশের মানুষ। বেসরকারি খাতে হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজের অনুমোদন দিয়েছে সরকার। বেসরকারি খাতেও স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়ানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশ্বের অনেক প্রতিষ্ঠিত অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের বাংলাদেশে আসার সুযোগ করে দিতে হবে বলে উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, এ বিষয়ে আমাদের ডাক্তারদের উদার হতে হবে। দরজা বন্ধ করে রাখলে আলো-বাতাস বাসায় ঢোকে না। এ বিষয়ে বিশেষভাবে ভাববেন।

শেখ হাসিনা বলেন, দেশে অনেক প্রতিষ্ঠিত শিক্ষক রয়েছেন। তাদেরও সামনে আসার সুযোগ করে দেওয়া উচিত। তারা যেন তাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারেন। তাদের সঙ্গে কাজ করলে অভিজ্ঞতা বাড়ার সুযোগ হবে। এ বিষয়ে আরও বেশি উদার হতে হবে। সুপার স্পেসালাইজড হাসপাতাল দেশের চিকিৎসাসেবায় নব দিগন্ত উন্মোচিত করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, এ হাসপাতাল চালু হলে বাংলাদেশের বার্ষিক আনুমানিক ৩৫০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে।

বাংলাদেশে অনেক বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে প্রথম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথাও অনুষ্ঠানে স্মরণ করে এবং প্রত্যেক বিভাগীয় শহরে একটি করে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাতেও তাঁর সরকারের পদক্ষেপ গ্রহণের উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।

এর মাধ্যমে দেশের চিকিৎসাব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ফলে বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার নির্ভরশীলতা কমবে এবং অন্তত ৪ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক। এতে বিশেষ অতিথি ছিলেন স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব মো. সাইফুল হাসান বাদল, অতিথি ছিলেন রিপাবলিক অব কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত লি জ্যাং কিউন। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বিএসএমএমইউর উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ।

বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বিএসএমএমইউর উত্তর পাশে ৩ দশমিক ৮ একর (প্রায় ১২ বিঘা) জমির ওপর এই সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১২ সালে। ২০১৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ১ হাজার ৩৬৬ কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্পের অনুমোদন মেলে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (একনেক) নির্বাহী কমিটিতে। ২০১৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী এ প্রকল্পের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। এ হাসপাতাল নির্মাণে দক্ষিণ কোরিয়া সরকার থেকে ১ হাজার ৪৭ কোটি টাকা ঋণ সহযোগিতা পাওয়া গেছে। নির্মাণকাজ সম্পন্ন করছে হুন্দাই করপোরেশন কোরিয়া। হাসপাতালের নকশা করেছে সানজিন ইঞ্জিনিয়ারিং কোরিয়া। সুপরিসর ১২ তলা ও তিনটি বেজমেন্ট নিয়ে মাল্টি ডিসিপ্লিনারি অ্যান্ড সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালটি হবে ৭৫০ শয্যার। এর বহির্বিভাগ থেকে প্রতিদিন ৮ হাজার রোগী সেবা পাবে। এতে থাকছে ১০০টি আইসিইউ বেডসহ ইমার্জেন্সি বেড। পাঁচটি ভিন্ন সেন্টারে থাকছে জরুরি চিকিৎসাসেবা, মা ও শিশু কেন্দ্র, কার্ডিওভাসকুলার সেন্টার, হেপাটোবিলিয়ারি অ্যান্ড গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি সেন্টার ও কিডনি ডিজিজ সেন্টার। ১৪টি অত্যাধুনিক অপারেশন থিয়েটার, যেখানে বিভিন্ন অঙ্গ প্রতিস্থাপনসহ উন্নত মানের সার্জারি সম্পন্ন হবে। দেশে বর্তমানে সিঙ্গাপুর, কোরিয়াসহ বিশ্বের অধিকাংশ উন্নত দেশে সেন্টার বেইজড চিকিৎসা সেবা পদ্ধতি চালু থাকলেও এই ধরনের হাসপাতাল দেশে প্রথম। এ বিষয়ে বিএসএমএমইউর উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল চালু হওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবায় একটি নতুন যুগের সূচনা হবে। হাসপাতালটি চালু হলে দেশেই রোগীরা বিশ্বমানের চিকিৎসা সেবা পাবেন। চিকিৎসার প্রয়োজনে রোগীদের দেশের বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হবে না।

তিনি বলেন, দেশে চিকিৎসকদের জন্য অত্যাধুনিক পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা, বায়োমেডিকেল রিসার্চ, জিন থেরাপি, রোবটিক সার্জারি এবং জনগণের জন্য উচ্চমানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের লক্ষ্যে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়েছে। সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে হৃদরোগ, কিডনি রোগ, লিভার, গল ব্লাডার ও প্যানক্রিয়েটিক, অরগান ট্রান্সপ্লান্ট, ক্যান্সার ও নিউরোসার্জারিসহ বিভিন্ন জটিল রোগের বিশেষায়িত চিকিৎসার ব্যবস্থা বাংলাদেশে চিকিৎসাক্ষেত্রে একটি নতুন মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

 

 

সর্বশেষ খবর