ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং কেড়ে নিয়েছে ৩৬ প্রাণ। দেশের ১৪ জেলায় ঝড়ের সময় ট্রলারডুবি, গাছচাপা, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট ও পানিতে ডুবে এসব মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৪১৯ ইউনিয়নের ১০ হাজার ঘরবাড়ি ও ৬ হাজার হেক্টর জমির ফসল। বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছেন ৮০ লাখ গ্রাহক। লন্ডভন্ড সমুদ্রসৈকত। বিপর্যয় ট্রেন ও বিমান সূচিতে। গতকাল আবহাওয়া উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আশ্রয় কেন্দ্র থেকে নিজ বসতবাড়িতে ফিরেছেন উপকূলীয় মানুষ। বাড়ি ফিরে বসবাসযোগ্য বসতবাড়ি পাননি অনেক নিম্ন আয়ের মানুষ। ঝড়ে মৃত্যু হয়েছে চট্টগ্রামে ১০, ভোলায় ৫, টাঙ্গাইলে ৪, কুমিল্লায় ৩, মুন্সীগঞ্জে ২, গোপালগঞ্জে ২, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ২, খুলনায় ১, শরীয়তপুরে ১, পটুয়াখালীতে ১, বরগুনায় ১, নড়াইলে ১, নোয়াখালীতে ১, কক্সবাজারে ১ ও ঢাকায় ১ জনের। এর মধ্যে চট্টগ্রামের মিরসরাই উপকূলের সন্দ্বীপ চ্যানেলে বালু তোলার ড্রেজার ডুবে আট শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে সোমবার রাতে উপজেলার সাহেরখালী ইউনিয়নের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরের ৩ নম্বর জেটি এলাকার পশ্চিমে এ ড্রেজারডুবি ঘটে। মারা যাওয়া শ্রমিকরা হলেন- ইমাম মোল্লা, মাহমুদ মোল্লা, শাহীন মোল্লা, আল আমিন, মো. তারেক ও বাশার। অন্য দুজনের নাম জানা যায়নি। শ্রমিকদের সবার বাড়ি পটুয়াখালী সদর উপজেলার জৈনকাঠি। ড্রেজারটির মালিক সৈকত এন্টারপ্রাইজ নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ড্রেজারটি থেকে বেঁচে ফেরা শ্রমিক মো. সালাম জানান, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে তীব্র বাতাস ও ঢেউ ওঠায় সৈকত-২ নামে তাঁদের ড্রেজারটি মিরসরাই উপকূলের সন্দ্বীপ চ্যানেলে ডুবে যায়। সিত্রাংয়ের আঘাতের পর বঙ্গোপসাগরের সীতাকুন্ড উপকূল থেকে তিন মাসের একটি মেয়েশিশুর লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। সীতাকুন্ড থানার ওসি তোফায়েল আহমেদ বলেন, গতকাল (মঙ্গলবার) সকালে ভেসে আসা তিন মাসের একটি শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়। আইনি প্রক্রিয়ার জন্য শেষে গাউসিয়া কমিটির সহায়তায় লাশটি দাফন কাফন হবে। চট্টগ্রামের চান্দগাঁও থানার মোহরায় সৃষ্ট জোয়ারে পানি থেকে আসবাবপত্র সরানোর সময় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মোবারক হোসেন নামে এক যুবক নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন তার পরিবারের আরও তিন সদস্য। তারা হলেন- সালাউদ্দিন, রাশেদা বেগম ও সাদ্দাম। ভোলায় ঝড়ের সময় চরফ্যাশন উপজেলার হাজারীগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বাজার এলাকায় গাছচাপায় মনির স্বর্ণকার (৪০), দৌলতখান পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডে ঘরের ওপর গাছ পড়ে খাদিজা বেগম (৮০), সদর উপজেলার ধনিয়া ইউনিয়নের পাকার মাথা এলাকায় বসতঘরের ওপর গাছ পড়ে মফিজুল ইসলাম (৬৫) মারা গেছেন। জোয়ারের পানিতে বাড়িঘর তলিয়ে গেলে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার সময় আয়শা বেগম (২৫) নামে এক নারী পানিতে ডুবে মারা যান। সদর উপজেলার আলীনগরে ঝড়ে রাস্তার ওপর ভেঙে পড়া গাছ কেটে সরাতে গিয়ে নাসির নামে আরেক ব্যক্তি মারা যান। কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের তান্ডবে গাছচাপা পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন একই পরিবারের তিনজন। সোমবার রাত ১০টার দিকে হেসাখাল ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের খামারপাড়া গ্রামে এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে। মৃতরা হলেন- মালয়েশিয়াপ্রবাসী নেজাম উদ্দিন (৩০), তার স্ত্রী শারমিন আক্তার সাথী (২৩) ও তাদের মেয়ে নুসরাত আক্তার লিজা (৩)। নেজাম উদ্দিন খামারপাড়ার হাজিবাড়ির আবদুর রশিদের ছেলে। মাসখানেক আগে তিনি মালয়েশিয়া থেকে দেশে আসেন। টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় পুলিশের দুই কনস্টেবল ও এক আসামি নিহত হয়েছেন। সোমবার রাতে মধুপুর-জামালপুর সড়কের গোলাবাড়ী এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। প্রচ- ঝড়বৃষ্টির মধ্যে নিহতদের বহন করা মাইক্রোবাস গোলাবাড়ী বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ট্রাককে ধাক্কা দেয়। নিহতরা- হলেন জামালপুর সদর উপজেলার নারায়ণপুর তদন্ত কেন্দ্রের কনস্টেবল নুরুল ইসলাম ও মো. সোহেল এবং আসামি লালন। একই সময় টাঙ্গাইল শহরের সাবালিয়া পাঞ্জাপাড়ায় ঘরে পানি ঢুকে আইপিএস তলিয়ে যেতে থাকায় তা উদ্ধার করতে গিয়ে বিদ্যুতায়িত হয়ে জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের শরীফ ফকির নামে এক কর্মীর মৃত্যু হয়েছে। শরীফ ফকির ওই এলাকার আইনজীবী আইয়ুব আলী ফকিরের ছেলে। মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার কনকসার গ্রামে ঘূর্ণিঝড়ে গাছ ভেঙে পড়লে বসতঘরের নিচে চাপা পড়ে মা আসমা বেগম আশু (২৮) ও মেয়ে সুরাইয়ার (৩) মৃত্যু হয়েছে। আহত অবস্থায় বাবা আবদুর রাজ্জাককে (৩৫) ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলার পাঁচকাহনিয়া গ্রামে ঘরের ওপর গাছচাপায় শারমিন বেগম মারা যান। একই উপজেলার বাঁশবাড়িযার চরপাড়া গ্রামে গাছ উপড়ে পড়ে রোমেছা বেগমের মৃত্যু হয়। খালিশপুর উপজেলার মুজগুন্নী পার্ক এলাকায় সোমবার দুপুরে প্রবল বৃষ্টির সময় ছাদ থেকে পড়ে এক তরুণীর মৃত্যু হয়েছে। শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার সিডারচরে গাছের নিচে চাপা পড়ে শাফিয়া বেগম (৬৫) নামে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। বরগুনা সদর উপজেলার বুড়িরচর ইউনিয়নের সোনাখালী গ্রামে সোমবার রাতে গাছচাপায় আমেনা খাতুন নামে এক শতায়ু মারা গেছেন। নোয়াখালীর সুবর্ণচরে ঘরের ওপর গাছ চাপা পড়ে সানজিদা আফ্রিদি (১) নামে এক শিশু মারা গেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে ক্ষতিগ্রস্ত বৈদ্যুতিক সঞ্চালন লাইনে সংস্কার কাজের সময় খুঁটি থেকে পড়ে রিপন মিয়া (২৮) নামে এক লাইনম্যানের মৃত্যু হয়েছে। একই জেলার কসবা উপজেলার গোপীনাথপুর ইউনিয়নের ধ্বজনগর গ্রামে ঝড়ে ঘরের ওপর গাছ ভেঙে পড়ে জয়নাল আবেদীন ভুঁইয়া নামে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। পটুয়াখালী সদর উপজেলায় লোহালিয়া ইউনিয়নের প্রতাপপুর লঞ্চঘাটে নোঙর করা অবস্থায় ট্রলারডুবিতে নুরুল ইসলাম (৪০) নামে এক ট্রলারশ্রমিক মারা গেছেন। সোমবার রাত ৯টার দিকে ট্রলারটি ডুবে যায়। নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলা পরিষদ চত্বরের ভিতরে মেহগনি গাছের ডাল ভেঙে মর্জিনা বেগম (৪০) নামে এক গৃহপরিচারিকার মৃত্যু হয়েছে। সিত্রাংয়ের প্রভাবে বৃষ্টি আর ঝড়ের মধ্যে ঢাকার হাজারীবাগে দেয়াল ধসে এক রিকশাচালকের মৃত্যু হয়েছে। কক্সবাজারের টেকনাফ স্থলবন্দরে জাহাজ থেকে পড়ে শৌমিং (৭০) নামে মিয়ানমারের এক নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে। শৌমিং মিয়ানমারের সিটওয়ে (আকিয়াব) এলাকার বাসিন্দা।
১০ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত : ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের আঘাতে দেশের ৪১৯টি ইউনিয়নের ১০ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্তের সংবাদ পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান। গতকাল সচিবালয়ে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং-পরবর্তী সার্বিক বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে প্রতিমন্ত্রী এ তথ্য জানান। প্রতিমন্ত্রী বলেন, যেভাবে সিত্রাং সৃষ্টি হয়েছিল, যেসব পূর্বাভাস ছিল, যেভাবে এর বিস্তৃতি ছিল এবং যেভাবে সরাসরি বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে আসছিল- সবাই পূর্বাভাস দিয়েছিল যে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হবে। কিন্তু সিত্রাং ঘূর্ণিঝড় হিসেবেই ছিল, এটা প্রবল বা অতিপ্রবল বা সুপার সাইক্লোন কোনোটাতেই রূপ নেয়নি। বাতাসের গতিবেগ ৮০ কিলোমিটারের ওপরে যায়নি। আমাদের যে ঘোষণা ছিল, সেই সময়ের অনেক আগেই অনেক দ্রুত গতিতে সিত্রাং উপকূল অতিক্রম করেছে। আমাদের পূর্বাভাস ছিল, এটা বরগুনা ও পটুয়াখালীর ওপর দিয়ে যাবে। কিন্তু পরে এটি আরও উত্তর-পূর্ব দিকে টার্ন নেওয়ার কারণে পটুয়াখালী, ভোলা, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের ওপর দিয়ে যায়। ঘূর্ণিঝড় সতর্কতার শুরু থেকেই আমাদের মাঠ প্রশাসন ও স্বেচ্ছাসেবকরা কাজ করেছেন। ৬ হাজার ৯২৫টি আশ্রয় কেন্দ্রে প্রায় ১০ লাখ মানুষকে আনা হয়েছিল জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আশ্রয় কেন্দ্রে রান্না ও শুকনা খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় যেহেতু রাত ১০টার পর অতিক্রম করেছে, আশ্রিত মানুষ মধ্যরাত থেকেই আশ্রয় কেন্দ্র ত্যাগ করে বাড়ি যাওয়া শুরু করেন। সকাল হতে হতে সব আশ্রয় কেন্দ্র খালি হয়ে যায়। এ পর্যন্ত আমাদের ৪১৯টি ইউনিয়ন ও প্রায় ১০ হাজার বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৬ হাজার হেক্টর এবং ১ হাজার মাছের ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ে বিভিন্ন স্থানে বেশকিছু গাছপালা ও বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে গেছে। উপকূলীয় জেলা ছাড়াও কুমিল্লা, গোপালগঞ্জ এমনকি ঢাকায়ও আঘাত হেনেছে সিত্রাং। এনামুর রহমান আরও বলেন, ঘরবাড়ি মেরামতের জন্য অবশ্যই আমরা মন্ত্রণালয় থেকে টিন দেব এবং গৃহনির্মাণ মজুরির জন্য নগদ অর্থ দেব। আমরা জেলা প্রশাসনকে বলেছি চাহিদা পাঠাতে। চাহিদা এলে বরাদ্দ দিতে পারব। আমাদের যথেষ্ট পরিমাণ টিন ও নগদ টাকা আছে।
২ হাজার বৈদ্যুতিক খুঁটি, বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন ৮০ লাখ গ্রাহক : ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের আঘাতে উপকূলীয় অঞ্চলে বিভিন্ন বিতরণ সংস্থার প্রায় ২ হাজার বৈদ্যুতিক খুঁটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। ঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র তুলে ধরে প্রতিমন্ত্রী বলেন, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার খুঁটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে পল্লী বিদ্যুতের ৮ শতাধিক খুঁটি রয়েছে। এ মুহূর্তে আমাদের অগ্রাধিকার হচ্ছে দ্রুত বিদ্যুৎ ফিরিয়ে আনা। হাসপাতালগুলোয় কত দ্রুত বিদ্যুৎ দেওয়া যায় সেদিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছি। উপকূলীয় অঞ্চলে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। আরইবির ৭২ লাখ, বিপিডিবির ৭ লাখ, ওজোপাডিকোর ৬০ হাজার গ্রাহক বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। তার ছিঁড়ে যাওয়ায় পুরোপুরি মেরামত না হওয়া পর্যন্ত এসব এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু করা যাচ্ছে না। প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমাদের ৪ কোটি ৮০ লাখ গ্রাহকের মধ্যে ৮০ লাখ এখনো বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন আছেন। আগামীকাল (আজ) নাগাদ বিদ্যুৎ পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলেও তিনি আশা করছেন।