ভারতের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ তুলেছে জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো। তাদের অভিযোগ, নারী ও শিশুসহ কমপক্ষে ৪০ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আন্দামান সাগরে ফেলে দিয়েছে ভারতীয় নৌবাহিনী।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার (ওএইচসিএইচআর), রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পরিবার ও তাদের আইনজীবীরা এই অভিযোগ করেছেন। বলা হয়েছে, ওই ৪০ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে জীবন রক্ষাকারী জ্যাকেট পরিয়ে মিয়ানমারের সামুদ্রিক সীমানার কাছে (আন্দামান সাগরে) ফেলে দেওয়া হয়।
গত বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানানো হয়। ওএইচসিএইচআর আরও জানায়, গত ৬ মে নয়াদিল্লি থেকে আটক করা রোহিঙ্গাদের ভারতীয় নৌবাহিনীর কর্তৃপক্ষ ৮ মে বিমানযোগে নিয়ে গিয়ে সাগরে ফেলে দিয়েছে। তাদের মধ্যে শিশু, নারী ও বৃদ্ধরাও ছিলেন। সাঁতরে তারা মিয়ানমারের কোনো এক দ্বীপে পৌঁছলেও তাদের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি।
ভারতের শরণার্থীবিষয়ক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ফিরে আসা বেশির ভাগই ভারতে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের নিবন্ধিত ছিলেন এবং তাদের বায়োমেট্রিক তথ্য সংগ্রহের অজুহাতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাদের আটক করেছিল।
এ ঘটনায় জাতিসংঘের পক্ষ থেকে একজন বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যিনি ঘটনা তদন্ত করবেন। পাশাপাশি ওএইচসিএইচআর ভারতের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, যেন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের এমন অমানবিক ও জীবনের জন্য হুমকি এ রকম পরিস্থিতিতে ঠেলে না দেওয়া হয়।
জাতিসংঘের মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষ প্রতিবেদক টম অ্যান্ড্রুজ বলেন, এই ঘটনা আন্তর্জাতিক সুরক্ষাপ্রাপ্য লোকদের প্রতি সরাসরি অবজ্ঞা এবং মানবতার বিরুদ্ধে এক নির্মম আচরণ। এটি আন্তর্জাতিক আইনের অন্যতম মৌলিক নীতির লঙ্ঘন। যেখানে কাউকে এমন কোনো জায়গায় ফেরত পাঠানো যাবে না, যেখানে তাদের জীবন বা স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়তে পারে।
অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি)-কে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পাঁচজন জানিয়েছেন, তাদের পরিবারের সদস্যরা এই অভিযানে অংশ নিয়েছিল। তাদের দাবি, ১৫ জন খ্রিস্টানসহ রোহিঙ্গার ওই দলটিকে প্রথমে প্লেনে করে নিয়ে যাওয়া হয় এবং পরে সাগরে ফেলে দেওয়া হয়।
এক রোহিঙ্গা শরণার্থী বলেন, তার ভাই ৮ মে স্থানীয় এক জেলের কাছ থেকে মোবাইল ধার করে ফোন করে জানায়, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ প্রথমে তাদের বেঁধে রাখা চোখ ও হাত খুলে দেয়। এরপর জীবন রক্ষাকারী জ্যাকেট পরিয়ে সাগরে ঝাঁপ দিতে বলে।
তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার বাবা-মাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে সাগরে ফেলে দেওয়া হয়েছে। আমি শুধু আমার বাবা-মাকে ফিরে পেতে চাই। আমার আর কিছু লাগবে না।’
মায়ানমারের সামরিক নেতৃত্বাধীন সরকারের মুখপাত্র থেট সোয়ে তাৎক্ষণিকভাবে মন্তব্যের জন্য পাঠানো ইমেইলের জবাব দেননি। এপি তাদের একটি ফোনালাপের রেকর্ডও পর্যালোচনা করেছে, যেখানে এক রোহিঙ্গা তার ভাইকে ফোনে জানাচ্ছেন, গ্রুপের কয়েকজনকে ভারতীয় নৌবাহিনী মারধর করেছে। ভারতের নৌবাহিনী ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। ভারতের বিরুদ্ধে এই অভিযোগগুলো বিশ্বজুড়ে সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
ভারত এখনো শরণার্থীদের জন্য কোনো জাতীয় নীতি বা আইন প্রণয়ন করেনি এবং ১৯৫১ সালের শরণার্থী কনভেনশন ও ১৯৬৭ সালের প্রটোকলেরও সদস্য নয়। তবুও দেশটিতে আনুমানিক ৪০ হাজার রোহিঙ্গা বসবাস করছেন, যাদের মধ্যে ২২ হাজার ৫০০ জন জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) নিবন্ধিত সদস্য। তারা মূলত ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে অনুন্নত, অপরিচ্ছন্ন ক্যাম্পে বসবাস করছেন এবং দীর্ঘদিন ধরে হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলোর টার্গেটে পরিণত হয়েছেন। অনেক রোহিঙ্গাকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে আটক করে ডিটেনশন সেন্টারে রাখা হয়েছে। কিছু রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে ফেরতও পাঠানো হয়েছে।
২০২৩ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার একটি বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন কার্যকর করে, যা সমালোচকদের মতে মুসলিম শরণার্থী, বিশেষত রোহিঙ্গাদের প্রতি বৈষম্যমূলক। এ ঘটনায় জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে ভারত সরকারের প্রতি রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার রক্ষার আহ্বান জানানো হয়েছে।
সূত্র : এপি।
বিডি-প্রতিদিন/শআ