মাত্র চার বৈঠকেই সংবিধান সংস্কার নিয়ে শতাধিক প্রস্তাব এসেছে সংবিধান সংস্কার কমিশনের কাছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য, গণভোট, নির্বাচনব্যবস্থা, সরকারব্যবস্থাসহ নানা বিষয়ে প্রস্তাব এসেছে। উল্লেখযোগ্যের মধ্যে রয়েছে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ না বলে ‘জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ’ বলা, রাষ্ট্রপতির পরিবর্তে রাষ্ট্রপ্রধান বলা, জাতির পিতা প্রশ্নে ‘ফাউন্ডিং ফাদার্স’ ধারণায় যাওয়া, গণভোট চালু করা, প্রাদেশিক সরকারব্যবস্থার বিধান না করা, সংসদের আসন সংখ্যা বাড়িয়ে ৪০০ করা, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট ব্যবস্থা প্রবর্তন, জাতীয় সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছরের পরিবর্তে চার বছর করা ইত্যাদি। এসব প্রস্তাব নিয়ে শিগগিরই প্রতিবেদন তৈরি করা হবে। সে প্রতিবেদন দেওয়া হবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহম্মদ ইউনূসের কাছে। যদিও এ প্রক্রিয়া নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন। কেউ বলেছেন, গণপরিষদ গঠন করে সংবিধানের অনুমোদন দেওয়া। আবার কেউ বলেছেন, পরবর্তী নির্বাচিত সরকার সংসদে সংবিধানের সংশোধন অনুমোদন করবে। অবশ্য সংবিধানের সংশোধন কীভাবে বাস্তবায়ন বা অনুমোদন করা হবে তা সংবিধান সংস্কার কমিশনের কার্যপরিধিভুক্ত নয়। এটি সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয়। কমিশনের কাজ সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করে তা সরকারের কাছে দেওয়া। কমিশন ছয়টি কাজ করবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। এগুলোর মধ্যে রয়েছে সংবিধানের সামগ্রিক সংশোধন, সংযোজন, বিয়োজন, পরিমার্জন, পুনর্বিন্যাস এবং পুনর্লিখন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্র্তী সরকার ১০টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। এর মধ্যে সংবিধান সংস্কার কমিশনসহ ছয়টি কমিশন কাজ শুরু করেছে। ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ছয়টি কমিশন সরকারের কাছে তাদের সংস্কার প্রস্তাব জমা দেওয়ার কথা। অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বাধীন সংবিধান সংস্কার কমিশন অংশীজনদের সঙ্গে মতবিনিময় শুরু করেছে। কমিশন চারটি বৈঠকের মাধ্যমে অংশীজনদের মতামত নিয়েছে। ব্যক্তির পাশাপাশি সংগঠনেরও মতামত নিচ্ছে কমিশন। এক দিনেই ১৬টি সংগঠনের ৩১ জন প্রতিনিধি গিয়ে প্রায় অর্ধশত সংস্কারের কথা জানিয়ে এসেছে। কমিশনকে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর পক্ষ থেকে ৯টি লিখিত প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এসবের মধ্যে রয়েছে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন, সংসদের আসন সংখ্যা বাড়িয়ে ৪০০ করা, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট ব্যবস্থা প্রবর্তন, প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য টার্ম লিমিট নির্ধারণ (দুই টার্মের বেশি না), সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের সংস্কার, সর্বস্তরে জনপ্রতিনিধিত্বের শাসন প্রতিষ্ঠা, সব জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বীকৃতিসহ সংবিধানকে অসাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্যের দলিলে পরিণত করা ও জাতীয় সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছরের পরিবর্তে চার বছর করা। ব্যক্তি পর্যায়েও অনেকে সংবিধানের নানা দিক সংস্কারে নিজেদের মতামত দিয়েছেন। অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শব্দ ও ভাষা চয়নের ক্ষেত্রে পুরুষতান্ত্রিক ও সামন্ত শব্দ পরিহার করে সংবিধানের ভাষায় জেন্ডার সংবেদনশীলতা আনা দরকার। যেমন ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ না বলে ‘জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ’ বলা। রাষ্ট্রপতি না বলে রাষ্ট্রপ্রধান বলা ইত্যাদি। প্রজা থাকলেই রাজার প্রশ্ন আসে। এটাই সামন্ত চিন্তা। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাব তৈরির পর গণপরিষদ নির্বাচন করার প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি। এ গণপরিষদ সংবিধান অনুমোদন করবে। তিনি প্রাদেশিক সরকারব্যবস্থা না করে স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা, দুর্নীতি দমন কমিশনকে সাংবিধানিক সংস্থা করা এবং স্থানীয় সরকার ও শাসন কমিশন নামে একটি কমিশন করাসহ বেশ কিছু প্রস্তাব দিয়েছেন।
অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ বলেন, তিনি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ করা, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের সংস্কার; সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচার-এ তিন বিষয়কে সংবিধানের মূলনীতি ঘোষণা করা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার মধ্যে কিছু ভারসাম্য আনা, জাতির পিতা প্রশ্নে ‘ফাউন্ডিং ফাদার্স’ ধারণায় যাওয়া, গণভোট চালু করা, প্রাদেশিক সরকারব্যবস্থার বিধান না করা, আনুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতিতে না যাওয়া, কখন জরুরি অবস্থা জারি করা যাবে তা সংবিধানে স্পষ্ট করা, সংবিধানের পরিশিষ্টে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর তালিকা দেওয়াসহ বিভিন্ন প্রস্তাব দিয়েছেন। সভাগুলোয় কমিশনপ্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ, কমিশনের সদস্য অধ্যাপক সুমাইমা খায়ের, ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিকী, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইকরামুল হক, ড. শরীফ ভূঁইয়া, ব্যারিস্টার এম মতিন আলম ফিরোজী, ফিরোজ আহমেদ ও মো. মুস্তাইন বিল্লাহ অংশগ্রহণ করেন।