আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক দল গঠনের ছড়াছড়ি দেখা যাচ্ছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর গড়ে প্রতি মাসে তিনটি করে রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটছে। এ পর্যন্ত মোট ২৪টি নতুন দলের আত্মপ্রকাশের তথ্য পাওয়া গেছে।
ছোট্ট একটি দেশে এত রাজনৈতিক দল গঠনের প্রয়োজনীয়তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এসব দলের মাঠপর্যায়ে সাংগঠনিক ভিত্তি না থাকলেও রাজনৈতিক নতুন দল গঠনের হিড়িক চলছেই। অবস্থা দেখে মনে হতে পারে, রাজনীতিতে নতুন বিপ্লব এসেছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বেশির ভাগ দল শুধু আত্মপ্রকাশেই সীমাবদ্ধ, মাঠে তাদের তেমন কোনো কার্যক্রম নেই।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিগত এক-এগারো সরকারের সময় এভাবে নতুন নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের হিড়িক পড়েছিল। ওই দলগুলো আত্মপ্রকাশ করেছিল তদানীন্তন শাসকদের মদতে। বিগত কয়েকটি সংসদ নির্বাচনের আগেও এ রকম রাজনৈতিক দল গঠনের কারবার দেখা গেছে। তারা জোট করে কিংবা এককভাবে সরকারের সুবিধা নিয়ে ভোট করেছে। এখনো রাজনৈতিক দল গঠনের মহোৎসব চলছে।
নতুন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, বৈষম্যবিরোধী জুলাই আন্দোলনের প্রথম সারিতে থাকা শিক্ষার্থীদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। অন্য দলগুলোর বেশির ভাগেরই স্পষ্ট কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নেই। কিছু দল শুধু আত্মপ্রকাশেই সীমাবদ্ধ। অনেকেই এখনো কোনো রাজনৈতিক বা সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরুই করতে পারেনি। আবার কয়েকটি দল বিভিন্ন থানা ও জেলায় আংশিক কিছু কমিটি দেওয়ার চেষ্টা করছে। অন্যদিকে কয়েকটি দল অল্প কয়েকজন সদস্য নিয়েই যাত্রা শুরু করেছে বলে তাদের পক্ষে মাঠে কোনো কার্যক্রম নেওয়ারও সুযোগ নেই। কেউ কেউ ঢাকাকেন্দ্রিক দল গঠন করে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন পাওয়ার চেষ্টা করছে। বেশ কয়েকটি দল আত্মপ্রকাশের দিন দেশ ও জাতির কল্যাণে এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনে ব্যাপক কাজ করার ঘোষণা দিলেও সেগুলো ঘোষণাতেই হারিয়ে গেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, একটি রাজনৈতিক দলের একটা আদর্শ থাকে, একটা নীতিমালা। কিন্তু এ দলগুলোর এসব কিছু নেই। ফলে রাজনৈতিক কার্যক্রম থাকে না। এগুলোর মধ্যে বেশির ভাগ দল আসে শুধু আর্থিক সুবিধা লাভের উদ্দেশে। দলগুলোর একটা বড় অংশ নির্বাচনে অংশগ্রহণও করে না। করলেও কোনো প্রার্থী জেতার রেকর্ড একেবারেই কম এমনকি প্রার্থীদের জামানতও হারাতে হয়। তারপরও নির্বাচন এলেই রাজনৈতিক দল গঠনের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে কিছু মানুষ।
সর্বশেষ গত ১৭ এপ্রিল রাজধানীর বনানীতে একটি হোটেলে আত্মপ্রকাশ করেছে বাংলাদেশ আ-আম জনতা পার্টি (বিএজেপি)। আত্মপ্রকাশকালে ৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন দলটির আহ্বায়ক ডেসটিনি গ্রুপের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল আমীন। দলের সদস্যসচিবের দায়িত্বে আছেন ফাতিমা তাসনিম। গত ১৪ এপ্রিল ভাসানী অনুসারী পরিষদ থেকে ভাসানী জনশক্তি পার্টি নামের একটি রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ হয়েছে। রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের অডিটোরিয়ামে এক প্রতিনিধি সম্মেলনে এই দল গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়। ১১ এপ্রিল জাতীয় প্রেস ক্লাবে গণতান্ত্রিক নাগরিক শক্তি নামের নতুন একটি রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করে। এ দলের চেয়ারম্যান ড. আবদুল মালেক ফরাজী। গত ২০ মার্চ রাজধানী ঢাকায় ঘোষণার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে জনতার দল। এ দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. শামীম কামাল। আর সদস্যসচিবের দায়িত্ব পালন করছেন আজম খান। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশ জন-অধিকার পার্টি। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ‘নতুন সমাজ সমৃদ্ধ দেশ, হোক জনগণের বাংলাদেশ’ স্লোগান সামনে রেখে বাংলাদেশ সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি নামের একটি রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করে। গত ৪ জানুয়ারি দেশ জনতা পার্টি নামের একটি নতুন রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করে।
গত ২৮ জানুয়ারি মেজর জেনারেল (অব.) মো. এহতেশাম উল হকের নেতৃত্বে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক শক্তি নামের একটি দলের আত্মপ্রকাশ ঘটে। গণঅধিকার পরিষদ ভেঙে আসা একাংশের সদস্যরা চলতি বছরের ২৮ জানুয়ারি আমজনতার দল নামের একটি নতুন দলের নাম প্রকাশ করে। চলতি বছরের ১৩ মার্চ জাতীয় প্রেস ক্লাবের আবদুস সালাম হলে আইনজীবীদের নেতৃত্বে জনতার বাংলাদেশ পার্টি নামের নতুন একটি রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করে। গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার একটি হোটেলে এস এম শাহাদাতের নেতৃত্বে আত্মপ্রকাশ করে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক পার্টি। ওয়ার্ল্ড মুসলিম কমিউনিটি নামের একটি দল আত্মপ্রকাশ করে গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর। গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর আত্মপ্রকাশ করা রাজনৈতিক দল সমতা পার্টির আহ্বায়ক হানিফ বাংলাদেশি। গত বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর আত্মপ্রকাশ পাওয়া নতুন দল সার্বভৌমত্ব আন্দোলন। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের ১৮ দিন পর ২৩ আগস্ট প্রথম রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে নিউক্লিয়াস পার্টি অব বাংলাদেশ (এনপিবি)। দলটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে আত্মপ্রকাশ করে। সেদিন দলটির পক্ষ থেকে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আহ্বায়ক হিসেবে নিজের নাম ঘোষণা করেন অধ্যাপক মোহাম্মদ সিদ্দিক হোসাইন। গত বছরের ১৬ নভেম্বর গাজীপুর মহানগরের টঙ্গী এলাকার সাবেক ছাত্রলীগ নেতার নেতৃত্বে বাংলাদেশ মুক্তির ডাক ৭১ নামের একটি রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ছাত্রলীগের মতোই লোগো নিয়ে গোপনীয়তার সঙ্গে ঢাকার একটি রেস্টুরেন্টে দলটির আত্মপ্রকাশ ঘটে। গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশ জনপ্রিয় পার্টি (বিপিপি)। ১৫ নভেম্বর বাংলাদেশ সংস্কারবাদী পার্টি (বিআরপি) নামের আরও একটি রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ২৮ নভেম্বর আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশ জাগ্রত পার্টি। ৩০ নভেম্বর আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক পার্টি (বিজিপি)। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ থেকে আত্মপ্রকাশ করে মুসলিম জাতীয়তাবাদী নতুন ধারার রাজনৈতিক দল জাতীয় বিপ্লবী পরিষদ। খোমেনী এহসানকে আহ্বায়ক এবং হাসান আরিফকে দলটির সদস্যসচিব ঘোষণা করা হয়।