অভ্যন্তরীণ বিবাদ থামিয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে সদস্য সংগ্রহ বাড়িয়েছে রাখাইনভিত্তিক রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো। মিয়ানমারের জান্তা সরকারকে হটিয়ে রাখাইনের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামতে রোহিঙ্গাদের উদ্বুদ্ধ করতে ধর্মীয় বয়ানও ব্যবহার করছে এসব গোষ্ঠী। এর ফলে রাখাইনে বসবাসকারী রোহিঙ্গারা যেমন কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়বেন তেমনি বাংলাদেশে আশ্রিত ১০ লাখ শরণার্থীর প্রত্যাবাসনও অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে। এমন পরিস্থিতিতে রাখাইন রাজ্যের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক ত্রাণসহায়তা ও সীমান্ত বাণিজ্য জোরদারের পাশাপাশি বাংলাদেশকে শরণার্থী শিবিরগুলোতে রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর প্রভাব কমানোর পরামর্শ দিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ।
গতকাল ‘বাংলাদেশ/মিয়ানমার : রোহিঙ্গা বিদ্রোহের ঝুঁকি’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে সংস্থাটি। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ মিয়ানমার ও বাংলাদেশ-বিষয়ক সিনিয়র কনসালট্যান্ট থমাস কিন বলেন, গত ছয় মাস ধরে বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরগুলোতে নিজেদের অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীগত লড়াই থামিয়ে শরণার্থীদের নিজেদের দলে ভেড়ানোর কাজ জোরদার করেছে রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো। তারা বলছে, আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে লড়াই করাই বাড়ি ফিরে যাওয়ার একমাত্র উপায়। তিনি আরও বলেন, আরাকান আর্মি এখন উত্তর রাখাইন রাজ্যের পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করছে। এ ধরনের বিদ্রোহ সফল হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তবে এটি সীমান্তের উভয় পাশেই ব্যাপক ক্ষতি ডেকে আনতে পারে এবং বাংলাদেশে থাকা ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর প্রত্যাবাসনও চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের প্রশাসনকে শরণার্থী শিবিরে তৎপর সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর প্রভাব কমিয়ে এনে রোহিঙ্গা নাগরিক সমাজের জন্য কাজের পরিসর তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি আরাকান আর্মিকেও সব সম্প্রদায়ের স্বার্থ অক্ষুণ্ন রেখেই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে সংলাপের প্রাথমিক প্রচেষ্টা শুরু করতে হবে। ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো ইতোমধ্যেই রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মির ওপর হামলা শুরু করেছে এবং সীমান্তের শিবিরগুলোতে যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এটি রাখাইন রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ এবং রোহিঙ্গা মুসলিম সংখ্যালঘুদের মধ্যে আরও রক্তপাতের ঝুঁকি বাড়াবে। পাশাপাশি সংঘাত থেকে বাঁচতে আরও রোহিঙ্গা সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেবে। পাশাপাশি মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে জনমতকে প্রভাবিত করবে এবং সে দেশে নাগরিকত্বসহ পূর্ণ অধিকার অর্জনে তাদের সংগ্রামকে দুর্বল করে দেবে। এ ছাড়াও এটি বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আরাকান আর্মির চলমান পরীক্ষামূলক আলোচনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। যা বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিগুলোতে আশ্রয় নেওয়া ১০ লাখের অধিক শরণার্থীর প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনাকে নষ্ট করবে। বাংলাদেশের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর সম্পৃক্ততার কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠী এবং আরাকান আর্মি-উভয়ের সঙ্গেই সম্পর্ক বজায় রাখা বাংলাদেশের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো রোহিঙ্গা গোষ্ঠীগুলোর ঐক্যের উদ্যোগকে সমর্থন দিয়েছে। তারা আরাকান আর্মিকে শরণার্থী ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করার একটি উপায় হিসেবে রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে ব্যবহার করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তারা গোষ্ঠীগুলোকে সরঞ্জাম দিয়ে কোনো সহায়তা দিচ্ছে কি না তা এখনো স্পষ্ট নয়, তবে এসব নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর এই সম্পৃক্ততা বাংলাদেশ সরকার এবং আরাকান আর্মির মধ্যে শুরু হওয়া আলোচনার সম্ভাবনাকে হুমকির মুখে ফেলছে। সংকট নিরসনে আরাকান আর্মি, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ও বাংলাদেশের মধ্যে আস্থা তৈরি করতে বলেছে ক্রাইসিস গ্রুপ। তারা জানিয়েছে, বাংলাদেশের উচিত রাখাইন রাজ্যের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক ত্রাণসহায়তা ও সীমান্ত বাণিজ্য জোরদার করা। একই সঙ্গে শরণার্থী শিবিরগুলোতে রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর প্রভাব কমানো। আরাকান আর্মির উচিত রাখাইনের সব সম্প্রদায়ের স্বার্থ অক্ষুণ্ন রেখে শাসন পরিচালনার চেষ্টা করা। আর বিদেশি দাতাদের উচিত যতদূর সম্ভব শরণার্থীদের জন্য সহায়তা কাটছাঁট সীমিত করা।