চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শেষ মুুহূর্তে এসেও বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফেরেনি। বরং এ সংকট আরও বেড়েছে। যার ফলে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। একই সঙ্গে সংকট মেটাতে ব্যাংক খাত থেকে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ঋণ নিয়ে ফেলেছে সরকার। বিদেশি ঋণের বোঝাও বেড়েছে। সামগ্রিক অর্থনীতিতে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে এসব ঋণ পরিশোধ। যদিও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন ঠেকানো সম্ভব হয়েছে। অবশ্য এর অন্যতম কারণ হচ্ছে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমে যাওয়া। এর ফলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগেও ভাটা পড়েছে। যার প্রভাব পড়ছে কর্মসংস্থানের ওপর। ফলশ্রুতিতে অর্থবছর শেষে জিডিপি প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৩ শতাংশের নিচে নেমে আসবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। একই সঙ্গে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এ সংকট আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত সর্বশেষ ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকসহ কয়েকটি প্রতিবেদন ঘেঁটে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
এদিকে ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে দেশের অর্থনীতির ওপর এর একটা বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। ইরান যদি হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেয় তবে তারও একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনের মতোই আগামী বছরের জন্য কয়েকটি চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করেছে অন্তর্বর্তী সরকারও। যেগুলোকে নতুন বাজেটে অগ্রাধিকার হিসেবে স্থান দেওয়া হয়েছে। এগুলো হলো- অর্থনৈতিক কার্যক্রমে ধীরগতি, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তা, দক্ষ জনশক্তি তৈরি ও কর্মসংস্থান বাড়ানো, আর্থসামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, রাজস্ব আয় বাড়ানো, ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়ন, এলডিসি থেকে উত্তরণ প্রস্তুতি এবং শিল্পের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর মতো চ্যালেঞ্জগুলোকে সঙ্গে নিয়ে নতুন একটি অর্থবছর ২০২৫-২৬ শুরু করতে যাচ্ছে সরকার। এখন সংকটময় অবস্থায় রয়েছে। আগামীতে আরও সংকটের মুখোমুখি হওয়ার শঙ্কা আছে। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি হচ্ছে। এ কারণে বাজেট বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়ছে।
অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে বাংলাদেশ সরকারের জন্য বেশ কয়েকটি সুপারিশ করেছে বিশ্বব্যাংক। এর মধ্যে আছে- রাজস্ব আদায় ব্যবস্থায় ব্যাপক সংস্কার করে আয় বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া, রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য এনে আয় বাড়ানো, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি সঠিক খাতে কার্যকর করা, অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়ানো এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির পদক্ষেপ নেওয়া। কাজগুলো দ্রুত সম্পন্ন করলে অর্থনীতি আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে বলে বিশ্বব্যাংক মনে করছে। এসব বিষয়ে অবশ্য ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে কয়েকটি উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি ও রাজস্ব খাতের সংস্কার। সামাজিক সুরক্ষা খাতেও নতুন করে ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়িয়ে বাজেট পাস করা হয়েছে। তবে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য এখন পর্যন্ত কার্যকর তেমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয়নি অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে। বিশ্বব্যাংক মনে করে, বাংলাদেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক বাণিজ্যে মন্দা, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি এবং ঋণ পরিশোধের চাপসহ অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক নানা কারণ এ সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। যদিও বাংলাদেশ এসব সংকট মোকাবিলা করে সামনে এগোচ্ছে। কিন্তু সংকটের প্রভাবে জনজীবনে যেসব আঘাত লেগেছে সেগুলোর উপশম এখনো হচ্ছে না। এজন্য সরকারকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়াতে হবে, রাজস্ব আয় ও কর্মসংস্থান বাড়ানোর পথ সুগম করতে হবে। অবশ্য মূল্যস্ফীতির চাপ কিছুটা কমে আসার কথা জানিয়ে অর্থ বিভাগের সচিব খায়েরুজ্জামান মজুমদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতির চাপ কমে আসবে, যা ইতোমধ্যে কমতে শুরু করেছে। আগামী জুনের মধ্যে এটা সাড়ে ৬ শতাংশে নেমে আসবে। একই সঙ্গে এ সময়ের মধ্যে রাজস্ব খাত সংস্কার এবং রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রেও অগ্রগতি হবে বলে তিনি মনে করেন।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রধান চালিকাশক্তি হচ্ছে তৈরি পোশাকশিল্প। কিন্তু ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার দেশগুলোতে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ক্রেতাদের চাহিদা কমে গেছে। এ কারণে ওইসব দেশে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি কমে যাচ্ছে। ফলে সেসব দেশ থেকে আয়ও হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এতে আগামীতে এ খাতে নানা জটিলতার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হবে বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চ্যালেঞ্জ। এ তালিকা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশের রপ্তানি খাতকে আরও বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। যার মোকাবিলার জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নেওয়ার সুপারিশ করেছে বিশ্বব্যাংক।