উত্তরা মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ত আবদুল মাকিন। যুদ্ধবিমান দুর্ঘটনায় ৭০ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল তার শরীর। জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল দুপুর ১টার দিকে মারা যায় মাকিন। এর আগে সকাল সাড়ে ৯টায় আয়মান (১০) নামে আরেক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। আয়মান মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ত। সে বার্ন ইনস্টিটিউটের ফিমেল হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিটে (এফএইচডিইউ) চিকিৎসাধীন ছিল।
রাজধানীর চার হাসপাতালে বর্তমানে চিকিৎসাধীন আছেন ৫০ জন। এর মধ্যে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে একজন, শহীদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একজন, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে আটজন, বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ৪০ জন। গতকাল পর্যন্ত যুদ্ধবিমান দুর্ঘটনায় মোট ৩৩ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। যুদ্ধবিমান দুর্ঘটনায় আহত হয়ে বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন রয়েছে তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী শেখ সায়েবা মেহজাবিন। তার মা শারমিন ইয়াসমিন সুরভী বলেন, স্কুল ছুটি শেষে সায়েবা দোলনায় খেলছিল। ও আমাকে দেখে ডেকেছিল, তারপর আগুনের মধ্যে পড়ে যায়। ওর শরীরের ২২ শতাংশ পুড়ে গেছে। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর সায়েবা বলেছে, আম্মু তুমি দেরি করেছো কেন? রাস্তায় যানজটের কারণে আমার আসতে ৫ মিনিট দেরি হয়েছিল। আমি দেরি না করলে আমার মেয়ে আজ ভালো থাকত। ড্রেসিং করার সময় মেয়ের চিৎকার আর কান্না সহ্য করা যায় না। ওকে নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছি। হাসপাতালের আইসিইউ, এইচডিইউ, পোস্ট অপারেটিভে চিকিৎসাধীন রোগীদের অধিকাংশই শিশু। আইসিইউতে চলছে জীবনমৃত্যুর লড়াই আর বাইরে উৎকণ্ঠায় স্বজনরা। আইসিইউর বাইরে সন্তানের জন্য অঝোরে কাঁদছেন বাবা-মা, স্বজনরা। কেউ সৃষ্টিকর্তার কাছে দুই হাত তুলে কোলের সন্তানের জীবন ভিক্ষা চাইছেন। স্বজনদের আহাজারিতে হাসপাতালে তৈরি হয়েছে হৃদয়বিদারক দৃশ্য। গতকাল রোগীদের সার্বিক অবস্থা বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে বার্ন ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের মধ্যে পাঁচজনের অবস্থা সংকটাপন্ন, ১০ জন আশঙ্কাজনক এবং ২৫ জন রোগী মাঝামাঝি অবস্থায় আছেন। এর মধ্যে ১৫ জনকে কেবিনে স্থানান্তর করা হয়েছে। আগামীকাল ৪-৫ জন রোগীকে ছেড়ে দেওয়া হতে পারে। ভেন্টিলেশনে থাকা দুজনের অবস্থা কিছুটা উন্নতি হয়েছে, তারা নিজেরা শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারছে। তিনি আরও বলেন, আজ (শুক্রবার) আমরা সংকটাপন্ন অবস্থায় থাকা দুই শিশুকে হারিয়েছি। সকালে আয়মান এবং দুপুরে মাকিন আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। আয়মানের বাড়ি শরীয়তপুরে, মাকিনের বাড়ি গাজীপুরে। তাদের মৃতদেহ যথাযথভাবে দাফনের জন্য সংশ্লিষ্ট দুই জেলার সিভিল সার্জনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জানা যায়, চীনের চিকিৎসক প্রতিনিধিদল যুদ্ধবিমান দুর্ঘটনায় আহত রোগীদের চিকিৎসা পর্যবেক্ষণে হাসপাতালে পৌঁছেছে। প্রতিনিধিদল হাসপাতালে রোগীদের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা নিয়ে চিকিৎসকদের সঙ্গে আলোচনা করেছে। এ ছাড়া ভারত ও সিঙ্গাপুরের চিকিৎসক প্রতিনিধিদলও হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা নিয়ে চিকিৎসকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছে।
তিন শিশুর দাফন গ্রামে গ্রামে মাতম : উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহত চারজনের দাফন ফরিদপুর, মেহেরপুর, কুমিল্লা ও গাজীপুরে সম্পন্ন হয়েছে। এদের একজন হল শিশু শিক্ষার্থী রাইসা, আরেকজন মাহিয়া তাসনিম, মাহতাব অপরজন মা আফসানা প্রিয়া। লাশ দাফনের সময় তিন স্থানেই শোকের মাতম শুরু হয়। আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো বিবরণ-
ফরিদপুর : ভোরে যখন লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সটি বাড়ির আঙিনায় এসে দাঁড়ায়, সেখানে আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন নারী-পুরুষসহ অসংখ্য মানুষ। তারা ছোট্ট রাইসার লাশ দেখতে ভিড় করেন। কিন্তু লাশ দেখতে না পেয়ে অনেকেই হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন। উপস্থিত নারীদের কান্নায় প্রকৃতি ভারী হয়ে ওঠে। কেউই চোখের পানি আটকে রাখতে পারেননি।
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে মর্মান্তিক যুদ্ধবিমান দুর্ঘটনায় নিহত তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী রাইসা মণির লাশ গতকাল ভোরে তার বাড়ি ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গার বাজড়া গ্রামে আনা হয়। সকাল ৯টার দিকে গোপালপুর ইউনিয়নের বাজড়া ঈদগাহ ময়দানে জানাজা শেষে বাজড়া কবরস্থানে তার দাফন সম্পন্ন হয়। রাইসার জানাজায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নেন। রাইসার মৃত্যুতে শোকে স্তব্ধ গ্রামবাসী।
পরিবার সূত্রে জানা গেছে, তিন সন্তানের মধ্যে এক সন্তানের মৃত্যুতে শোকে কাতর শাহাবুল-মিম দম্পতি। রাইসা মণির জন্মের দুই বছর আগে তাদের কোলজুড়ে আসে বড় মেয়ে সিনথিয়া (১৩) এবং সবার ছোট ছেলে রাফসান শেখ (৪)। রাইসা মণির মা-বাবার ইচ্ছা ছিল সন্তানদের ভালো স্কুলে পড়ানোর। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে ভালোমানুষ হিসেবে গড়ে তোলার। সে লক্ষ্যে রাইসাকে ভর্তি করেছিলেন উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে। রাইসা মণি তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ত আর একই স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী তার বড় বোন সিনথিয়া। রাইসার বাবা শাহাবুল শেখ কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার মেয়েটা বলেছিল, বাবা, ছুটির পর তুমি আমাকে নিতে এসো। আমি ছুটির পর স্কুলে গিয়েছি কিন্তু মেয়েকে পাইনি। শেষবারের জন্যও কলিজাটাকে দেখতে পারলাম না। আমার বড় মেয়েটাও ওই স্কুলে পড়ে। সে আর স্কুলে যেতে চাইছে না। সে আমাকে বলে, যদি স্কুলে আবার বিমান ভেঙে পড়ে? তার চোখে মুখে ভয় দেখতে পেয়েছি। আমি ছোট মেয়েকে হারিয়েছি, বড় মেয়েটিকে হারাতে চাই না।’
মেহেরপুর : যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহত মাহিয়া তাসনিমের দাফন সম্পন্ন হয়েছে। মাহিয়া তাসনিম চুয়াডাঙ্গার কুড়ালগাছি গ্রামের মৃত প্রকৌশলী মোহাম্মদ আলীর মেজো মেয়ে এবং মুজিবনগর উপজেলার জয়পুর গ্রামের নজরুল হক নগরীর নাতনি। কয়েক বছর আগে মাহিয়ার বাবা প্রবাসে থাকাকালে মারা যান। মাহিয়া তার মায়ের সঙ্গে ঢাকার উত্তরা কর্ণফুলী ১৮ নম্বর সেক্টরে থাকত।
গতকাল সকাল ৯টায় মুজিবনগর উপজেলার জয়পুর গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে তার দাফন সম্পন্ন হয়। এর আগে সাড়ে ৮টায় কবরস্থান ময়দানে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় মেহেরপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক তরিকুল ইসলাম, মুজিবনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পলাশ ম ল, মুজিবনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মিজানুর রহমানসহ গণ্যমান্য ব্যক্তি ও শত শত মানুষ অংশ নেন। ঢাকার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী মাহিয়া সোমবার সকালে স্কুলে যাওয়ার পর মর্মান্তিক দুর্ঘটনার শিকার হয়। তার শরীরের প্রায় ৫০ শতাংশ পুড়ে যায়। জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টায় তার মৃত্যু হয়। রাতে তার লাশ প্রথমে চুয়াডাঙ্গার কুড়ালগাছি গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয় এবং গতকাল সকালে মুজিবনগরের জয়পুর গ্রামে নানাবাড়িতে আনা হয়। লাশ গ্রামে পৌঁছালে একনজর দেখতে শত শত মানুষ ভিড় করেন। পুরো এলাকায় নেমে আসে শোকের ছায়া। কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে পরিবেশ। স্বজনদের চোখে অশ্রু আর মুখে বিষাদের ছাপ। বারবার ভেঙে পড়ছিলেন পরিবারের সদস্যরা, প্রতিবেশীরা তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেন।
মাহিয়ার নানা নজরুল হক নগরী বলেন, ‘বিমান বিধ্বস্ত হয়ে ওখানকার অষ্টম শ্রেণির অনেক শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মাহিয়া তার বাবার মতোই মেধাবী ছিল। স্বামী হারিয়ে মেয়েকেও হারিয়ে আমার মেয়ে আজ একেবারে একা হয়ে গেল। এ ক্ষতি পূরণের নয়।’
কুমিল্লা : ঢাকার মাইলস্টোন স্কুলে দুর্ঘটনার পর ঝলসে যাওয়া একটি ছেলের দৌড়ের ভিডিও সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল। ওই ছেলেটিই মাহতাব রহমান ভূঁইয়া। সেই মাহতাব না-ফেরার দেশে চলে গেছে। বৃহস্পতিবার রাতে তাকে কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার চুলাশ গ্রামের কবরস্থানে দাফন করা হয়। সে চুলাশ গ্রামের ভূঁইয়াবাড়ির মিনহাজুর রহমার ভূঁইয়া ও লিপি আক্তার দম্পতির একমাত্র ছেলে। মাহতাব তিন ভাই-বোনের মধ্যে দ্বিতীয় ছিল। তার বড় বোন নাবিলা একই স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী এবং ছোট বোন নাইসার বয়স তিন বছর। তারা ঢাকার উত্তরায় থাকত। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় ঢাকা থেকে মাহতাবের লাশ গ্রামের বাড়ি নিয়ে আসা হয়। এ সময় স্বজনদের কান্নায় পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। দেবিদ্বার উপজেলার রাজামেহার ইউনিয়নের চুলাশ-উখারী বাজার ঈদগাহ মাঠে রাত পৌনে ১০টায় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। জানাজায় উপস্থিত ছিলেন দেবিদ্বার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবুল হাসনাত খাঁন। নামাজ পড়ান স্থানীয় মসজিদের ইমাম লোকমান হোসেন।
মাহতাবের বাবা মিনহাজুর রহমার ভূঁইয়া বলেন, ‘মৃত্যুর আগে আমার সোনামানিক আমাকে সান্ত্ব¡না দিয়ে বলেছিল, বাবা আমার জন্য টেনশন কোরো না, আমি সুস্থ হয়ে যাব ইনশাল্লাহ।’ তিনি চোখ মুছতে মুছতে বলেন, ‘১৪ বছর বয়সে কেউ তার নামে বাসায় বিচার দেয়নি। শান্ত ছেলে বাসায় থাকলেও বোঝা যেত না। সে ক্লাসের ফার্স্ট বয় ছিল। মেধাবী সোনামানিক ছেলে আমার।’ একসময় গলা ধরে আসে তার। তিনি চুপ করে থাকেন। থেমে আবার বলা শুরু করেন, ‘হাসপাতালে গিয়ে ছেলের শরীরের অবস্থা দেখে নিজেকে স্থির রাখতে পারি না। সোনামানিক ছেলে আমার কী যে কষ্ট পেয়েছে? তার ৭৫ ভাগ শরীর পুড়ে গেছে। ডাক্তাররা অনেক চেষ্টা করেছেন তাকে বাঁচাতে। আল্লাহর ফয়সালার ওপরে আমার কোনো কথা নাই। আল্লাহ যেন তাকে শহীদের মর্যাদা দান করেন। দেশবাসী আমার ছেলের জন্য দোয়া করেছেন, আমি সবার কাছে কৃতজ্ঞ।’
গাজীপুর : উত্তরার দিয়াবাড়ি এলাকায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় স্কুল থেকে ছেলেকে আনতে গিয়ে নিখোঁজ হওয়া মা আফসানা আক্তার প্রিয়ার (৩০) লাশ পাওয়া গেছে। ব"হস্পতিবার দিবাগত রাতে গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার চাপাইর ইউনিয়নের মেদী আশুলাই গ্রামে তার লাশ পৌঁছায়। পরে জানাজা শেষে রাত ৩টার দিকে দাফন সম্পন্ন হয়। ডিএনএ পরীার পর ব"হস্পতিবার বিকেলে নিহতের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন স্বজনরা। দুর্ঘটনার পর ওই স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির শিার্থীআফসান ওহী (৯) অত অবস্থায় ফিরে এলেও আফসানা প্রিয়া ওই দিন থেকে নিখোঁজ ছিলেন। নিহত আফসানা প্রিয়া গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার চাপাইর ইউনিয়নের মেদী আশুলাই গ্রামের ব্যবসায়ী আবদুল ওহাব ম"ধার স্ত্রী।