বাংলার কবি-সাহিত্যিক ও সুধীজনরা শরৎকালকে ঋতুর রানি বলে অভিহিত করেন। শরৎকালে প্রকৃতি হয় কোমল, শান্ত-স্নিগ্ধ ও উদার। শ্রাবণ শেষে বিরামহীন বাদলের সমাপ্তি ঘটলেই প্রকৃতি নতুন রূপে সজ্জিত হয়। এ সময় আকাশের বুকে ভেসে চলে সাদা-শুভ্র পেঁজা তুলোর মতো মেঘমালা। মাটিতে ও সবুজ ধানের ডগায় রোদ আর ছায়ার লুকোচুরি খেলা দেখা যায়। মাঠে মাঠে সবুজ ধানের চারা খুশিতে নেচে ওঠে। ঘাসে শিশির পড়ে। সূর্যের কিরণ হয় দীপ্তোজ্জ্বল আর বাতাস হয় অমলিন। ভাদ্রের ভোরের সূর্য মিষ্টি আলোর স্পর্শ দিয়ে প্রকৃতির কানে কানে ঘোষণা করে শরতের আগমনি বার্তা। তাই শরতের আগমনে বাংলার প্রকৃতি থাকে নির্মল ও স্নিগ্ধ। শরতের আগমনে বাংলার প্রকৃতি দোয়েল, কোয়েল, ময়না, টিয়ার মধুর গুঞ্জনধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে। তাইতো স্নিগ্ধ শরৎ ঋতুকে নিয়ে রয়েছে অনেক জনপ্রিয় গান। যার মধ্যে রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি, জীবনানন্দের লেখা কবিতা থেকে গান এবং অন্য আধুনিক গানগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
শরৎ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিভিন্ন ঋতুভিত্তিক গান অসংখ্য। ঋতুর রানি শরৎকে নিয়ে তার সৃষ্টি যেন বাঙময় হয়ে উঠেছে সৃষ্টিশীল কলমে। শরতের বর্ণনাময় গানে আমাদের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ ও সুবাসিত করেছেন কবিগুরু। তিনি লিখেছেন- ‘শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি, ছড়িয়ে গেল ছাড়িয়ে মোহন অঙ্গুলি।’ তিনি শরৎ নিয়ে লিখেছেন- ‘আকাশ হতে খসল তারা’, যে গানটিতে শরতের প্রকৃতি ও একাকিত্বের অনুভূতি প্রকাশিত হয়েছে। শরতের আগমনের সুর নিয়ে তাঁর ‘কার তরে’ গানটি অন্যরকম দ্যোতনা সৃষ্টি করে। শরতের শিউলি ফুলের অপরূপ সৌন্দর্য ও আগমনকে নিয়ে কবিগুরুর আরেকটি গান ‘ওগো শিউলি-বনের মনের কামনা’। এদিকে শরতের ঝলমলে রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে কবিমন আনন্দে উচ্ছল হয়ে উঠত। ‘ধানের খেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা’র এ দিনে সবাইকে নিয়ে মেঘ কেটে যাওয়ার রোদমাখা আনন্দের দিনে কবিমন মেতে উঠতে চায়। শরৎ যেন পরিপূর্ণতার ঋতু, মনোরম ঋতু। তাইতো তিনি গেয়েছেন, ‘আজি শরততপনে প্রভাতস্বপনে কী জানি পরান কী যে চায়।’ সবকিছুর ঊর্ধ্বে শরতের রৌদ্রোজ্জ্বল দিন, মেঘমুক্ত আকাশ, শুভ্র শেফালি ও শিশিরে রোদের জ্বলে ওঠার মাঝে কবির চেতনাস্রোত প্রবাহিত। শরৎ নিয়ে তাঁর গানগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘দেখো শুকতারা আঁখি’, ‘হেমন্তে কোন বসন্তেরি’, ‘তোমরা যা বলো তাই বলো’, ‘আমার রাত পোহালো শারদ’, ‘শরত আলোর কমলবনে’, ‘হৃদয়ে ছিলে জেগে’, ‘সেই তো তোমার পথের’, ‘শিউলি ফুল, শিউলি ফুল’, ‘তোমার মহনরূপে’, ‘দেখো দেখো, দেখো শুকতারা’ ইত্যাদি। এ ঋতুরঙ্গমঞ্চে বর্ষার বিষণ্নতা শেষ হয়ে গেলে শিউলি ঝরানো পথে অরুণ আলোর অঞ্জলি নিয়ে নিঃশব্দে চরণ ফেলে আসে শরৎ। ঝিমিয়ে যাওয়া প্রকৃতি যেন হঠাৎই প্রাণ পেয়ে ফুরফুরে হয়ে কেয়াপাতার নৌকা গড়িয়ে তালদিঘিতে ভাসিয়ে দেয়, আর তা দেখে কবির মন তখন পুলকিত হয়ে গেয়ে ওঠে, ‘আলোর কমলবনে, বাহির হয়ে বিহার করে যে দিল মনেমনে’। বর্ষার ঘনঘটা কেটে গিয়ে যখন নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলায় উড়ে বেড়ায় বকপাঁতি, তখন রবীন্দ্রনাথের মনও মুক্তির আনন্দে বলে ওঠে, ‘অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া, দেখি নাই কিছু দেখি নাই এমন তরণী বাওয়া।’ কখনোবা নদীর কিনারে কাশগুচ্ছে মৃদুমন্দ হাওয়ায় দোলা আর ঝরা মালতীর সুবাসে মাতাল হয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রিয় শরৎকে স্বাগত জানিয়ে গেয়েছেন-‘আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ, আমরা গেঁথেছি শেফালিমালা’। আরও কিছু রবীন্দ্রসংগীত রয়েছে শরৎকে নিয়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শরতের আকাশের রূপের সঙ্গে প্রেম আর মান-অভিমান মিলিয়ে এক অপূর্ব অনুভব সৃষ্টি করেছেন ‘শরতের অশুভ্র আকাশে’ গানে। শরতের কোমলতা ও বিশুদ্ধতা রয়েছে তাঁর ‘আমার গানের স্বর্ণলিপি’তে। রবীন্দ্রনাথ শরতের আগমনে আত্মহারা, তারই অনুরণন তার কবিতায়-গানে, ‘মেঘের কোলো রোদ হেসেছে...কী করি আজ ভেবে না পাই, পথ হারিয়ে কোন বনে যাই’। শরৎ নিয়ে রয়েছে গান, ‘ওগো শেফালি ওগো শেফালি’, ‘আজ শরতে আলোর বাঁশি বাজলো’, ‘এসো শারদ প্রাতের পথিক’। আকাশভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ’-গানটিও শরতের মনোরম আবহকে ফুটিয়ে তোলো।
শরৎ বন্দনায় নজরুল
এদিকে বাংলা সাহিত্যাকাশে উজ্জ্বল ধূমকেতু কবি কাজী নজরুল ইসলাম। অন্যায়-অত্যাচার ও পরাধীনতা তাঁকে বিদ্রোহী করে তুললেও, প্রেম-বিরহের চির কাঙাল কবি শরতেরও জয়গান গেয়েছেন তাঁর গানে। চিরসবুজ এসব গানে পুলকিত হয় পাঠকমন। বিদ্রোহী কবির গহিন হৃদয়ে ঝরনার মতো জমানো এত প্রেম, সত্যিই বিস্মিত করে তোলে। কবি শরতের রূপ তুলে ধরেছেন এভাবে- ‘সই পাতালো কি শরতে আজিকে স্নিগ্ধ আকাশ ধরণি?’ অনেকের মতে, শরৎকালে নাকি ভালোলাগার অনুভবে মনটা নেচে ওঠে। ছুটি ও উৎসবের নেশায় মন ছুটে যায়। কারণ এ শরৎকালে মাঠে মাঠে সবুজ ধানের ওপর সোনালি আলোর ঝলমলে রূপ দেখা যায়। প্রতীক্ষায় থাকে কৃষকরা আসন্ন নবান্নের আশায়। শরৎকাল নিয়ে কবি নজরুলের গান, ‘আজ শরতে আনন্দ ধরে না ধরণীতে, একি অপরূপ সেজেছে বসুন্ধরা নীলে হরিতে’। এ গানে ফুটে উঠেছে প্রকৃতির পালাবদলে- উৎসবমুখর শরতের ‘নীল-হরিৎ’ বর্ণে অপরূপ সাজে সজ্জিত বসুন্ধরা যেন আনন্দে আত্মহারা। ‘শরতেরই আকাশেতে’ গানে নজরুল বন্দনা করেছেন শরতের স্নিগ্ধতাকে। কাজী নজরুল ইসলামের ‘হেরিনু পল্লী জননী’ গানে শরৎ ঋতুর বৈশিষ্ট্য ও রূপমাধুর্য উপস্থাপন করেছেন এভাবে- ‘শিউলি-ছোপানো শাড়ি প’রে ফের আগমনী গীতি গাহিয়া’। তার গান ‘এসো শিউলি বিছানো পথে এসো, এসো নির্মল নীলপথে’ ও ‘দূর প্রবাসে প্রাণ কাঁদে আজ শরতের ভোর হাওয়ায়’তে শরতের স্নিগ্ধতা, শিউলি ফুলের সুবাস এবং শরতের আকাশকে চমৎকারভাবে চিত্রিত করেছেন নজরুল। শরৎ নিয়ে নজরুলের আরেকটি গান- ‘কোন্ শরতে পূর্ণিমা-চাঁদ আসিলে এ ধরাতল, কে মথিল তব তরে কোন্ সে ব্যথার সিন্ধু-জল’। ধারণা করা হয়, নজরুল শরৎচন্দ্রের জন্মজয়ন্তী উপলক্ষেই ভাদ্র মাসেই গানটি রচনা করেছিলেন। এ সময় নজরুলের বয়স ছিল ২৮ বছর ৩ মাস। আরেকটি গান রয়েছে শরৎ নিয়ে, সেটি হলো- ‘এলো ঐ পূর্ণশশী ফুল জাগানো, বহে বায় বকুল বনে ঘুম ভাঙানো’।
শরৎকাল নিয়ে আরও যেসব গান
জীবনানন্দ দাশ শরৎকাল নিয়ে সরাসরি কোনো গান রচনা করেননি, তবে তিনি তাঁর অসংখ্য কবিতায় শরৎকালের সৌন্দর্যকে তুলে ধরেছেন এবং তাঁর কবিতায় প্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে প্রিয়তমার রূপ বর্ণনা করেছেন। যেমন, তাঁর ‘এখানে আকাশ নীল’-এ তিনি সজিনার ফুলকে শরতের আশ্বিনের আলোর সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি ‘আবার আসিব ফিরে’ কবিতা-গানে বাংলাকে অন্যভাবে উপস্থাপন করেছেন। শরৎ ঋতুকে নিয়ে লোপামুদ্রা মিত্র- রূপঙ্কর গেয়েছেন ‘ওই আসছে শরৎ হাওয়া’ নামে আধুনিক গান। যেখানে শরতের হাওয়া, সাদা মেঘ আর প্রকৃতির রূপ ফুটে উঠেছে। মান্না দে গেয়েছেন- ‘আজ শরতে কাশের বনে’।
বাংলা সাহিত্য জগতে মহাকবি কালিদাস ‘মেঘদূত’ কাব্যের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন। মহাকবি কালিদাস শরৎ বন্দনায়ও ছিলেন অগ্রবর্তী। তিনি বলেন, ‘প্রিয়তম আমার, ঐ চেয়ে দেখ, নববধূর ন্যায় সুসজ্জিত শরৎকাল সমাগত।’