২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রোজা শুরুর আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। এর মাধ্যমে নির্বাচন আয়োজনের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হলো বলে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে।
গতকাল নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব বরাবর পাঠানো এক চিঠিতে উল্লিখিত সময়ে প্রত্যাশিত মানের অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের জন্য অনুরোধ করেন প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়া।
৫ আগস্ট জুলাই গণ অভ্যুত্থান দিবসে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে দেওয়া তাঁর ভাষণে আগামী বছর ফেব্রুয়ারি মাসে রোজা শুরুর আগে নির্বাচন আয়োজনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দেওয়ার কথা বলেন। তারই ধারাবাহিকতায় গতকাল এ চিঠি পাঠাল প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়।
জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণের উল্লেখ করে চিঠিতে বলা হয়, প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ভাষণে অবিলম্বে এক্ষেত্রে সব প্রস্তুতি ও প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন শুরুর কথা বলেছেন। বিগত ১৫ বছরে নাগরিকদের ভোট দিতে না পারার প্রেক্ষাপটে আগামী নির্বাচন যেন মহা আনন্দের ভোট উৎসবের দিন হিসেবে স্মরণীয় হয় তেমন আয়োজনের ওপর প্রধান উপদেষ্টা জোর দিয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়।
প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ভাষণে নির্বাচন আনন্দ-উৎসবে, শান্তিশৃঙ্খলায়, ভোটার উপস্থিতিতে, সৌহার্দ ও আন্তরিকতায় অবিস্মরণীয় হয়ে ওঠার যে প্রত্যাশা করেছেন তা উল্লেখ করা হয়। নির্বাচন আয়োজনে যথোপযুক্ত প্রযুক্তি ব্যবহারের গুরুত্বারোপের পাশাপাশি একটি প্রত্যাশিত সুষ্ঠু, অবাধ, শান্তিপূর্ণ, উৎসবমুখর নির্বাচন আয়োজনে সরকারের সর্বাত্মক সহযোগিতার প্রত্যয়ের কথাও নির্বাচন কমিশনকে জানানো হয়। চিঠির শেষে প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণার ভিত্তিতে উল্লেখিত সময়ে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের জন্য অনুরোধ করেন প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব।
নানা চ্যালেঞ্জ থাকলেও প্রস্তুতি এগিয়ে যাচ্ছে : সিইসি
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেছেন, তফসিল ঘোষণার আগে নির্বাচন কমিশন সভায় আলোচনা করে মনোনয়নপত্র দাখিল, বাছাই, প্রত্যাহারের শেষ সময় ও ভোটের তারিখ নির্ধারণ করা হয়ে থাকে।
গতকাল আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে নিজ কার্যালয়ে এক ব্রিফিংয়ে নাসির উদ্দিন বলেন, দ্রুত চিঠি পেয়ে যাব বলে আশা করছি। না পেলেও আমরা আগে থেকে প্রস্তুতি নিচ্ছি।
ভোটে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআইয়ের অপব্যবহার রোধ করার বিষয়টিও ইসির সামনে আরেকটি চ্যালেঞ্জ বলে জানিয়েছেন সিইসি। তিনি বলেন, ভোটারদের কেন্দ্রে উপস্থিতি বাড়ানো বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা নির্বিঘ্ন পরিবেশ নিশ্চিত করতে চাই, যেন উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের জন্য এক মাস সময় রাখার পরিকল্পনা রয়েছে ইসির। নাসির উদ্দিন বলেছেন, নির্বাচনি পরিবেশ আগামী কয়েক মাসে আরও উন্নত হবে। এখন কোনো সমস্যা দেখছেন না তিনি। ফেব্রুয়ারির ভোট সামনে রেখে জনগণের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনা, দলগুলোর আস্থা অর্জন, ভোটারদের ব্যাপক অংশগ্রহণকেই চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন সিইসি।
প্রধান উপদেষ্টার জাতির উদ্দেশে ভাষণের পরদিন গতকাল দুপুরে নিজেদের প্রস্তুতির আদ্যোপান্ত তুলে ধরেন সিইসি। তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা মঙ্গলবার একটা ঘোষণা দিয়েছেন। উনি বলেছেন, ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে রমজানের আগে ইলেকশন করার জন্য আমাদের একটা চিঠি দেবেন। আমি প্রত্যাশা করছি দ্রুত চিঠিটা পেয়ে যাব। চিঠি এখনই না এলেও ঘোষিত সময়সীমা ধরে প্রস্তুতি চলমান থাকবে নির্বাচন কমিশনের। সিইসি বলেন, প্রস্তুতি আমরা অনেক আগে থেকে নিচ্ছি। প্রস্তুতিতে ঘাটতি হবে না। সুন্দর নির্বাচন করার জন্য যে ধরনের প্রস্তুতি ইসির নেওয়া দরকার তা চলছে বলে জানান তিনি।
প্রধান কাজগুলোর মধ্যে নিখুঁত ভোটার তালিকা হালনাগাদ খসড়া প্রকাশ এবং ৩১ আগস্টের মধ্যে চূড়ান্ত হবে। ভোটারযোগ্য তরুণদের অন্তর্ভুক্ত করতে তফসিলের মাসখানেক আগে একটা সময় নির্ধারণ করে সম্পূরক তালিকা করা হবে।
দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের জন্য এক মাস সময় : ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে দলগুলোর আলোচনা শেষ হলে নির্বাচন কমিশনও অংশীজনের সংলাপে বসবে। এ জন্য প্রায় এক মাস সময় পরিকল্পনা করে রেখেছেন বলে জানান সিইসি।
সিইসি বলেন, একটা ইলেকশনের স্বচ্ছতার জন্য যা যা দরকার, তার মধ্যে রুল অব মিডিয়া ইজ নম্বর ওয়ান। আমরা কিন্তু ইলেকশনটাকে এজ ট্রান্সপারেন্ট এজ পসিবল করতে চাই; আয়নার মতো পরিষ্কার করতে চাই। মানুষ, বিশ্ববাসী দেখুক যে আমাদের আন্তরিকতা, আমাদের চেষ্টার কোনো ঘাটতি আছে কি না। লুকিয়ে কোনো কাজ করতে চাই না।
সেপ্টেম্বর ঘিরে নিবন্ধন, কেনাকাটা শেষ করতে চায় : এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেন, প্রস্তুতি নিয়ে বললে ভোটার লিস্টটা হয়ে যাচ্ছে। প্রকিউরমেন্ট টার্গেট ৩০ সেপ্টেম্বর শেষ করে ফেলতে পারব। টেন্ডার হয়ে গেছে। তারপর ডিলিমিটেশন (সীমানা নির্ধারণ) স্বচ্ছভাবে হয়েছে। শুনানি করে শেষ করা হবে। একটা বড় কাজ হয়ে গেছে পার্টি রেজিস্ট্রেশন। ইতোমধ্যে যাচাই-বাছাই চলছে। যারা শর্ত পূরণ করতে পারবে তাদের বিষয়ে তদন্ত হবে, এরপর কারও আপত্তি আছে কিনা ১৫ দিনের বিজ্ঞপ্তি হবে।... এসব বড় কাজ বাই সেপ্টেম্বর; ইনশাল্লাহ উই ওয়ান্ট টু কমপ্লিট অল দিস বিগ টাস্ক। পাশাপাশি ভোটের কাজে সম্পৃক্ত ৮-৯ লাখ লোকবলের প্রশিক্ষণের কাজও শুরু হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, ভোট গ্রহণ কর্মকর্তার পোস্টাল ব্যালটে ভোটের প্রস্তুতির বিষয়ও রয়েছে। আমরা এবার প্রায় ১০ লাখ লোকবলকে পোস্টাল ব্যালটের আওতায় নিয়ে আসার চেষ্টা করব।
লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরিতে নির্বাচন কমিশনের প্রচেষ্টার পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে সহযোগিতা চান সিইসি। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়ে এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেন, সুতরাং যেনতেন একটা নির্বাচন করে আপনারা জয়ের চেষ্টা করবেন না। আমাকে সাহায্য করুন। আমি একটা সুন্দর ক্রেডিবল ট্রান্সপারেন্ট ইলেকশন দিতে চাই। আপনাদের সহযোগিতা ছাড়া পারব না।
দলগুলোকে খেলার মাঠের পরিবেশ রক্ষায় সহযোগিতা চান তিনি। প্লেয়াররা যদি সবাই ফাউল করার নিয়তে মাঠে নামে যে আমরা ফাউলই করব; এখন রেফারির পক্ষে সে ম্যাচ পণ্ড হওয়া থেকে রক্ষা করা সম্ভব নয়। লালকার্ড কজনকে দেখাবেন আপনি? সুতরাং যারা খেলবেন তাদের তো দায়িত্ব আছে বিশাল। আমি এই মেসেজটা রাজনৈতিক দলগুলোকে দিতে চাই।
ভোটারদের ব্যাপক অংশ গ্রহণের মাধ্যমে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের প্রত্যাশার কথা জানান সিইসি। বলেন, আমাদের মূল মেসেজটা হলো- আমরা এবার ইলেকশনটাকে পার্টিসিপেটরি করতে চাই। ভোটারদের ব্যাপক অংশ গ্রহণ আমরা চাই।
অন্যতম চ্যালেঞ্জ যত : ভোটারদের আস্থা অর্জনকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন সিইসি। সেই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন ভালো রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনা এখন নম্বর ওয়ান চ্যালেঞ্জ হয়ে গেছে। ইসির তরফ থেকে যত রকমের সম্ভব প্রস্তুতি ফ্রি ফেয়ার ইলেকশনের জন্য সব ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান সিইসি। তিনি বলেন, চ্যালেঞ্জের মধ্যে একটা বললাম মানুষকে আস্থায় নিয়ে আসা। ভোটারদের আস্থা সৃষ্টির পাশাপাশি ভোটারদের কেন্দ্রে নিয়ে আসা। এক প্রশ্নের জবাবে সিইসি জানান, রাজনৈতিক দলের বক্তব্য নিয়ে মন্তব্য না করলেও ভবিষ্যতে কাজ দেখে ইসির প্রতি আস্থাশীল হবে তারা। আমি বিশ্বাস করি যে আমাদের কর্মকাণ্ড যতই তারা দেখবেন, আমাদের ওপর আস্থা সৃষ্টি হবে।