ক্ষণে ক্ষণে কৌশল পাল্টাচ্ছে রাষ্ট্র সংস্কারে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এরই অংশ হিসেবে এবার আলোচনার টেবিলে লম্বা সময় কাটাতে চায় তারা। চলতি সপ্তাহে আবারও আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসতে যাচ্ছে কমিশন। ঐকমত্যের একটি চূড়ান্ত রূপরেখা দেওয়াই তাদের লক্ষ্য। এজন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে অনানুষ্ঠানিক বৈঠককে। এরই মধ্যে বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক হয়েছে বলে জানিয়েছেন কমিশনসংশ্লিষ্টরা। শিগগিরই জাতীয় নাগরিক পার্টির সঙ্গেও বসবেন তাঁরা। এদিকে আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর শেষ হতে যাচ্ছে কমিশনের মেয়াদ। অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিনির্ধারণের সঙ্গে জড়িত প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদার প্রধান উপদেষ্টার এক বিশেষ সহকারী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানিয়েছেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ আরও বাড়ছে। কারণ জুলাই সনদ নিয়ে তারা ধারাবাহিকভাবে কাজ করছে। এজন্য সময় প্রয়োজন। কৌশলের অংশ হিসেবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এরই মধ্যে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই অনেক বিষয় খসড়া জুলাই সনদে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়াও দেখানো হয়েছে। অন্যদিকে খসড়া সনদের ওপর রাজনৈতিক দলগুলোর লিখিত মতামত নেওয়া আপাতত শেষ করেছে কমিশন। তাদের কৌশল ছিল বেশ কয়েকটি ইস্যুতে দলগুলোর নমনীয়তা। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো মৌলিক ইস্যুতে তাদের অনড় অবস্থানের কথাই পুনর্ব্যক্ত করেছে। পাশাপাশি সনদ বাস্তবায়নের পথ নিয়ে চাপ দিয়েছে কমিশনকে। সংশ্লিষ্টরা জানান, সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের জুলাই সনদের মৌলিক কয়েকটি বিষয়ে দলগুলোর মতপার্থক্যের মীমাংসা এখনো হয়নি। জুলাই সনদ নির্বাচিত সংসদ বাস্তবায়ন করবে নাকি নির্বাচনের আগেই আইনি ভিত্তি দিয়ে এর বাস্তবায়ন করা হবে-এই প্রশ্নেই বিরোধ প্রভাবশালী দলগুলোর মধ্যে। বিএনপি চায় এখন কোনো আইনি ভিত্তি না দিয়ে নির্বাচিত সংসদের জন্য রেখে দেওয়া। গণ অভ্যুত্থানের বছরপূর্তিতে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে যে জুলাই ঘোষণাপত্র দেওয়া হয়েছে, তাতেও বলা হয়েছে, নির্বাচিত সংসদ সংস্কারের সনদ বাস্তবায়ন করবে। জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আইনি ভিত্তি দেওয়া না দেওয়ার প্রশ্নেই বিএনপির সঙ্গে জামায়াত ও জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপির মূল বিরোধ। জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন দল এবং গণ অভ্যুত্থানের ছাত্র নেতৃত্বের দল এনসিপি নির্বাচনের আগেই আইনি ভিত্তি দিয়ে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের দাবিতে একটা অনড় অবস্থান নিয়েছে। এ ছাড়াও সংস্কারের প্রস্তাবের মধ্যে জাতীয় সাংবিধানিক কমিশন গঠন ও সংসদের উচ্চ কক্ষে ভোটের আনুপাতিক হারে বা পিআর পদ্ধতিসহ কয়েকটি মৌলিক বিষয়ে বিএনপির আপত্তি বা নোট অব ডিসেন্টসহ খসড়া দলগুলোকে দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়গুলোতে বিএনপির অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি। বিএনপির ওপর রাজনৈতিক চাপ তৈরির কৌশল হিসেবে জামায়াত ও এনসিপিসহ বিভিন্ন দল পাল্টা অবস্থান নিয়েছে। তবে জামায়াতসহ ইসলামপন্থি বিভিন্ন দল পিআর পদ্ধতির দাবিকে সামনে এনে আন্দোলনের কর্মসূচি নেওয়ার হুমকি দিচ্ছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের খসড়া সনদ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, কিছু কিছু বিষয় আলোচনা না হলেও তা জুলাই সনদে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া কিছু বিষয়ে সঠিকভাবে উপস্থাপন হয়নি। তিনি বলেন, আগের সনদে নির্বাচিত সংসদ পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করবে বলা হলেও, নতুন সনদে তা নেই। এ ছাড়া দ্বিতীয় দফার আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে অঙ্গীকারনামায় সনদকে সংবিধানের ওপরে রাখা হয়েছে। তবে কোনো ডকুমেন্ট সংবিধানের ওপরে হতে পারে না। যদি সনদ সংবিধানের ওপরে রাখা হয়, তাহলে ভবিষ্যতের জন্য খারাপ নজির হবে। জুলাই সনদ নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না বলা হয়েছে, এটাও সঠিক হয়নি।
জুলাই জাতীয় সনদ নিয়েও বিএনপির বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। দলটি সংবিধানের ওপরে সনদের প্রাধান্য চেয়েছে। সনদ সম্পর্কে আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না এ অঙ্গীকারেও সমর্থন করেছে দলটি। কোন কোন সংস্কার প্রস্তাব নির্বাচনের আগে বাস্তবায়নযোগ্য এ তালিকা ঐকমত্য কমিশনের কাছে চেয়েছে তারা। জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের গণমাধ্যমকে জানান, কমিশনের সংলাপে যেসব কথা হয়েছে, সনদে তার ভিন্নতা রয়েছে। কেন এমন হয়েছে, তা জানতে চেয়েছে জামায়াত।
জুলাই সনদের টেকসই বাস্তবায়নের জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা প্রয়োজন বলে জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সদস্যসচিব আখতার হোসেন। তিনি বলেন, যতগুলো জায়গায় পরিবর্তন করতে হবে, তাতে বর্তমান সংবিধানের ৬০-৭০ শতাংশের বেশি পরিবর্তন করতে হবে। এত বৃহৎ পরিবর্তন, সেটাও সংবিধান পুনর্লিখন করার সমান। যখন আমাদের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত লিখতেই হচ্ছে, সেখানে নতুন সংবিধানের প্রবর্তন করা, সেখানে অনেকে কেন বাধা দেখেন, তা ধোঁয়াশার জায়গা তৈরি করে।
জুলাই জাতীয় সনদের চূড়ান্ত খসড়া প্রস্তাবের ওপর জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে নির্ধারিত ২২ আগস্ট পর্যন্ত লিখিত মতামত জমা দিয়েছে ২৪টি রাজনৈতিক দল। জুলাই জাতীয় সনদের ভিত্তিতে আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে বেশির ভাগ দল। সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় অধিকাংশ দল জুলাই সনদের আইনগত ভিত্তি ও সুনির্দিষ্ট বাস্তবায়ন পদ্ধতি দাবি করেছে। কিছু বিষয় নিয়ে বিভিন্ন দল ভিন্নমত পোষণ করে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ (আপত্তি) দিয়েছে, সময়সীমার অনুপস্থিতি নিয়ে হতাশা ও সংশোধনের দাবিও করা হয়েছে। তবে এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সামগ্রিক প্রতিক্রিয়া ছিল মিশ্র। রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই সনদকে সার্বিকভাবে সমর্থনযোগ্য মনে করছে, যদিও খসড়ায় আইনি স্পষ্টতা, সময়সীমার অভাব ও বিভিন্ন প্রস্তাবে ভিন্নমত-এই তিনটি মূল ইস্যু নিয়েই সংশোধন ও আলোচনার দাবি তুলেছে। চলতি সপ্তাহে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ফের আলোচনা প্রসঙ্গে কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আলোচনায় অমীমাংসিত বিষয়গুলোতে সমঝোতার চেষ্টা করা হবে। কিন্তু তা নির্ভর করবে রাজনৈতিক দলগুলোর ইতিবাচক সহযোগিতার ওপর।