ব্যাংক খাতে ঋণখেলাপির হার ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশে বর্তমানে প্রতি পাঁচজন ঋণগ্রহীতার একজন খেলাপি। অর্থনীতিবিদদের মতে, এটি শুধু পরিসংখ্যানগত সংকট নয়, বরং দীর্ঘদিনের শাসনব্যবস্থার দুর্বলতা, রাজনৈতিক প্রভাব ও দায়মুক্তির সংস্কৃতির ফল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, গত জুন পর্যন্ত দেশে ঋণগ্রহীতা ৭৬ লাখ ৫ হাজার। এর মধ্যে ১৪ লাখ ৯ হাজার ঋণগ্রহীতা অর্থাৎ প্রায় ১৯ শতাংশ গ্রাহক ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে খেলাপির তালিকায় রয়েছেন।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত উদ্বেগজনক। ভারতে ঋণখেলাপির হার ২ শতাংশেরও কম। ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ায় ৩ শতাংশের নিচে। এমনকি শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের মতো দুর্বল অর্থনীতির দেশেও খেলাপির হার ৭ শতাংশের কম। সে তুলনায় বাংলাদেশের ১৯ শতাংশ খেলাপির হার ব্যাংক খাতের নাজুক অবস্থা প্রমাণ করছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক মন্দার কারণে অনেক প্রকৃত ব্যবসায়ীও সময়মতো ঋণ পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছেন। একই সঙ্গে ঋণ পুনঃতফসিলে ব্যর্থতা, পুনঃতফসিল করা ঋণের কিস্তি পরিশোধে বিলম্ব এবং পুরোনো ঋণে সুদের বোঝা বাড়তে থাকায় সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬ লাখ কোটি টাকায়। তিন মাস আগেও মার্চে খেলাপির পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি এবং ২০২৪ সাল শেষে ছিল ৩ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা।
বর্তমানে দেশের মোট ঋণের পরিমাণ প্রায় ২০ লাখ কোটি টাকা, অর্থাৎ মোট ঋণের প্রায় ৩০ শতাংশই এখন ঝুঁকিপূর্ণ বা চাপের মধ্যে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ ব্যাংক যখন ব্যাংকগুলোর প্রকৃত আর্থিক অবস্থার তথ্য প্রকাশ করতে শুরু করে, তখনই প্রকৃত খেলাপি ঋণের বিশাল পরিমাণ প্রকাশ্যে আসে। তাদের মতে, দীর্ঘদিন ধরে ঋণগ্রহীতারা নিয়ন্ত্রক সংস্থার নমনীয়তার সুযোগ নিয়ে ঋণখেলাপি হয়েও বিশেষ সুবিধা ভোগ করেছেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ঋণ পুনঃতফসিলের নিয়ম পরিবর্তনের কারণেও খেলাপির সংখ্যা বেড়েছে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ঋণখেলাপি ঘোষণার সময়সীমা ২৭০ দিন থেকে কমিয়ে ১৮০ দিন করা হয়, আর ২০২৫ সালের এপ্রিল থেকে তা আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ৯০ দিনে নামানো হয়েছে।
এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন বিভাগ মাঠপর্যায়ের অডিটের পর বেশ কিছু বড় ঋণখেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তবে ব্যবসায়ীরা বলেছেন, উচ্চ সুদহার এবং ঋণ পুনঃতফসিলে গঠিত কমিটির কার্যক্রমে ধীরগতির কারণে খেলাপি গ্রহীতা বেড়েছে।
এ বিষয়ে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ঋণ পুনঃতফসিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারের কিছু নির্দেশনা স্পষ্ট করতে আমরা গত বৃহস্পতিবার গভর্নরের সঙ্গে বৈঠক করেছি। বাংলাদেশ ব্যাংক সার্কুলার স্পষ্ট করলে অনেক ব্যবসায়ী ঋণখেলাপির তকমামুক্ত হতে পারবেন।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ব্যাংক খাতে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংককে দ্রুত কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। তাদের মতে, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত, জবাবদিহিমূলক ও স্বচ্ছ ব্যাংকিং ব্যবস্থা ছাড়া এ সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো প্রফেসর ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে কার্যত ভেঙে পড়েছিল। এখন তা পুনর্গঠন করে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে সুশাসন ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। ড. মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, বিপুল সংখ্যক খেলাপি ঋণগ্রহীতা আমাদের আর্থিক খাতে দীর্ঘদিনের দুর্বল পরিশোধ সংস্কৃতি ও শিথিল তদারকির প্রতিফলন। ঋণগ্রহীতা ও ঋণদাতাদের মধ্যে এক ‘অশুভ আঁতাত’ তৈরি হয়েছিল। এর ফলে ব্যাংক খাতে এক ধরনের দায়মুক্তির বিষাক্ত সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে।