জুলাই-আগস্ট গণ অভ্যুত্থানের সময় রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের বুক ও পেট গুলিতে ঝাঁজরা হয়েছিল। তার গলা থেকে ঊরু পর্যন্ত ছিল ছররা গুলির আঘাত। কিন্তু ময়নাতদন্তের রিপোর্টে বুলেট ইনজুরির পরিবর্তে হেড ইনজুরি লিখতে চাপ দেওয়া হয়। মামলার হুমকির পাশাপাশি প্রলোভন দেখানো হয় সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড কিংবা কক্সবাজার ভ্রমণের। চারবার পরিবর্তন করে শেষে পঞ্চমবারে রিপোর্ট জমা দিই। গতকাল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেওয়া জবানবন্দিতে কথাগুলো বলেন রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. রাজিবুল ইসলাম।
বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১ এ তিনি প্রসিকিউশনের ১৮তম সাক্ষী হিসেবে নিজের জবানবন্দি তুলে ধরেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তিনি সাক্ষ্য দেন। এর আগে প্রসিকিউশনের ১৭তম সাক্ষী একই হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিকেল বিভাগের অফিস সহকারী গিয়াস উদ্দিন এবং পরে কুষ্টিয়ার সাংবাদিক শরীফুল ইসলাম জবানবন্দি দিয়েছেন ট্রাইব্যুনালে। পরে এ মামলার পলাতক আসামি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন সাক্ষীদের জেরা করেন। মামলার একমাত্র গ্রেপ্তারকৃত সাক্ষী ও রাজসাক্ষী সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন আসামির কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন।
এ দিন প্রসিকিউশনের পক্ষে ট্রাইব্যুনালে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম, গাজী এম এইচ তামীম, বি এম সুলতান মাহমুদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এ মামলায় এখন পর্যন্ত ১৯ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। আরও সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আজকের দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল।
রংপুর মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. রাজিবুল ইসলাম তার জবানবন্দিতে বলেন, ‘২০২৪ সালের জুলাই মাসে ছাত্র আন্দোলন চলাকালে নিহত আবু সাঈদের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করি। তার বুক ও পেট গুলিতে ঝাঁজরা হয়েছিল। তার গলা থেকে ঊরু পর্যন্ত ছররা গুলির আঘাত দেখতে পাই। যথা নিয়মে আবু সাঈদের শরীরে পিলেট পাওয়া যায়। ময়নাতদন্তে আবু সাঈদের শরীরের বিভিন্ন স্থানে অনেক পিলেটবিদ্ধ হয়ে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেছেন মর্মে আমি মতামত দিয়েছি। সেখানকার মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে ওই রিপোর্ট জমা দিতে যাই। কিন্তু মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে রিপোর্ট গ্রহণ না করে পুনরায় রিপোর্ট তৈরি করতে বলেন। একই রিপোর্ট দ্বিতীয়বার ভাষাগত পরিবর্তন করে পেশ করি। কিন্তু সেটাও গ্রহণ করা হয়নি। এভাবে আমি তৃতীয় রিপোর্টও পেশ করি।’
জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ‘চতুর্থবার রিপোর্ট দেওয়ার আগে ৩০ জুলাই রংপুর মেডিকেল কলেজের ভাইস প্রিন্সিপালের (মাহফুজুর রহমান) রুমে আমাকে ডেকে নেওয়া হয়। সে সময়ে ডিজিএফআই, সিটিএসবি, পুলিশের ডিসি ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি (রংপুর) ডাক্তার চন্দন উপস্থিত ছিলেন। ওই সময় রুমের বাইরে অবস্থান করছিলেন ডিজিএফআই, এনএসআই ও পুলিশের অন্যান্য কর্মকর্তারা। তারা আমাকে বুলেট ইনজুরির পরিবর্তে হেড ইনজুরি মতামত দিয়ে ময়নাতদন্ত রিপোর্ট তৈরি করতে চাপ দেন। তারা বলেন, তাদের মনমতো রিপোর্ট না হলে আমার বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। তারা আরও বলেন, আপনার বিরুদ্ধে গোয়েন্দা রিপোর্ট আছে। এ ছাড়া আমাকে সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড ঘুরে আসার প্রলোভন দেখান তারা। তখন আমি বলি, আমার পাসপোর্ট নেই, তখন তারা আমাকে দুই সপ্তাহের জন্য কক্সবাজার ঘুরে আসতে বলেন, আমি বলি আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যার দৃশ্য সারা বিশ্বে লাইভে সম্প্রচারিত হয়েছে। আমি যদি হেড ইনজুরিতে মৃত্যু হয়েছে মর্মে রিপোর্ট দিই, তাহলে শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বের মানুষ ডাক্তার সমাজকে ঘৃণার চোখে দেখবে।’ ডাক্তার রাজিবুল তার জবানবন্দিতে বলেন, ‘এরপর স্বাচিপের সভাপতি ডাক্তার চন্দন আমাকে বলেন, আবু সাঈদের লাশ নিয়ে ব্যবসা চলছে। নেত্রী (শেখ হাসিনা) এ ব্যাপারে কনসার্ন আছেন। পুলিশ যেভাবে রিপোর্ট চায় সেভাবে রিপোর্ট দিয়ে দাও। তোমার বিষয়টা আমরা দেখব। এত কিছুর পরও আমি আমার অবস্থান থেকে সরে আসি নাই। আমি কোনো হেড ইনজুরি পাইনি। সর্বশেষ চতুর্থবার আমার প্রদত্ত রিপোর্টে ইনজুরির বর্ণনা ঠিক করলেও গানশট ইনজুরির কথা উল্লেখ করিনি। পিলেট ইনজুরিসহ অন্যান্য বর্ণনা দিয়ে রিপোর্ট পেশ করি। তার পর তারা সেটি নিয়ে যায়।’
সাক্ষী বলেন, ‘আমাকে অনবরত হুমকি প্রদান করা সত্ত্বেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমি সত্য রিপোর্ট প্রদান করেছি। যে তিনটি রিপোর্ট পূর্বে ফেরত দেওয়া হয়েছিল, তা আমি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত কর্মকর্তার কাছে জমা দিতে পেরেছি।’ তিনি আবু সাঈদ হত্যার নির্দেশ প্রদানকারী, হত্যার সহায়তাকারীসহ জড়িত সবার বিচার চান।
আনন্দমিছিল শেষে ফেরার পথে হত্যা করা হয় দুজনকে : গতকাল প্রসিকিউশনের ১৯তম সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দিয়েছেন কুষ্টিয়ার স্থানীয় পত্রিকার সাংবাদিক ৩২ বছর বয়সি শরীফুল ইসলাম। তিনি তার জবানবন্দিতে বলেন, ‘গত বছর ১৮ জুলাই কুষ্টিয়া শহরের চৌড়হাস বিমান মোড় এলাকায় আন্দোলনের অংশ হিসেবে মিছিল করছিলাম। ওই সময় ছাত্রলীগ-যুবলীগের হেলমেটধারীরা পুলিশি পাহারায় আমাদের ওপর হামলা করে। এরপর আমরা ওইদিন ওখানে আন্দোলন শেষ করে নিজ নিজ বাড়ি ফিরে যাই। তারপর পুলিশ আমাদের বিরুদ্ধে মামলা করে আমাদের খুঁজতে থাকে। সেই সময় আমরা কেউ বাসায় থাকতে পারতাম না। পুলিশ যুবলীগ-ছাত্রলীগের সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে আমাদের খোঁজ করত।’
তিনি জবানবন্দিতে বলেন, ‘গত বছর ৪ আগস্ট আন্দোলনের অংশ হিসেবে কুষ্টিয়া বড়বাজার রকশি গলি মোড়ে সমবেত হই। আমাদের লক্ষ্য ছিল মজমপুর গেটে গিয়ে আরও লোকজনের সঙ্গে একত্রিত হয়ে বিক্ষোভ করব। সেখানে পৌঁছলে দেখি প্রায় ১০ হাজার মানুষ সমবেত হয়েছে। খবর পাই চৌড়হাস এলাকায় আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ আক্রমণ করেছে। তখন আমরা সেখানে যাই। আমাদের উপস্থিতি বেশি থাকায় আক্রমণকারীরা চলে যায়। তখন আমরা আবার মজমপুর গেটে ফেরত আসি। সেখানে পুলিশ সারা দিন গুলি করে। আমরা পিছু না হটলে পুলিশ বলে, তারা আর গুলি করবে না, আমাদের বাসায় চলে যেতে বলে। তখন আমরা যে যার মতো বাড়ি ফিরে যাই।’
জবানবন্দিতে তিনি আরও বলেন, ‘৫ আগস্ট রকশি গলি মোড়ে সকাল ৯টার দিকে আমরা সমবেত হই। তখন আমাদের সংখ্যা ছিল ৩০-৩৫ জন। ওই সময় আমাদের সঙ্গে সর্বস্তরের মানুষ যোগ দেয়। ওই সময় আমরা থানার মোড়ের দিকে এগোনোর সময় এন এস রোডে জেলা পরিষদের কাছে মৌবন রেস্টুরেন্টের সামনে উপস্থিত হলে এসআই মোস্তাফিজসহ ৮-১০ জন হেলমেটধারী আমাদের ওপর শটগান দিয়ে গুলি শুরু করে। ওই সময় আমার দুই হাতে গুলি লাগে। আমি তখন একটি মসজিদে আশ্রয় নিয়ে কিছুক্ষণ রেস্ট নিই। কিছুক্ষণ পর আবার আন্দোলন শুরু করার জন্য মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে মা-খালাসহ সবাইকে ডাকি।’
সাংবাদিক শরীফুল জবানবন্দিতে বলেন, ‘খবর পাই শেখ হাসিনা পালিয়ে যাবে। ওই খবরটা আমি কুষ্টিয়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে বলি। তাকে বলি আমাদের ওপর গুলি করবেন না। তখন ওসি সাহেব হ্যান্ডমাইক দিয়ে আমাকে বলে ছাত্র-জনতাকে শান্ত করতে। ওই সময় এসআই মোস্তাফিজ আমাকে শটগান দিয়ে গুলি করতে থাকে। তখন আমাকে দুজন ছাত্র ডাকবাংলোর ভিতরে নেয়। পরে আমাকে চিকিৎসার জন্য তোফাজ্জল হেলথ সেন্টারে নিয়ে যায়। আমার দুই হাতে তিনবার অপারেশন হয়েছে। ৬২টা পিলেট বের করা হয়েছে। ডাক্তার জানিয়েছেন আমার শরীরে আরও ৫০০-এর অধিক পিলেট রয়েছে, যা বের করা সম্ভব নয়। এ সময় সাক্ষী তার বাম হাতের এক্সরে ফিল্ম ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করেন। সাক্ষী শরীফুল জানান, ৫ আগস্ট দিনের বেলা কুষ্টিয়া শহরে ছয়জন পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন। একই দিন সন্ধ্যার পর আনন্দমিছিল করে ফেরার পথে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের লোকজন কুপিয়ে হত্যা করেছে আরও দুই ছাত্রকে।’
এ হত্যাকাণ্ডের জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক পুলিশ প্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদেরসহ সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যদের দায়ী করে তাদের বিচার দাবি করেন সাক্ষী।