জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ৪৯৩ জন এক চোখ এবং ১১ জন দুই চোখ চিরতরে হারিয়েছেন। দুই চোখেই দৃষ্টিস্বল্পতায় ভুগছেন ২৮ জন এবং এক চোখে দৃষ্টিস্বল্পতায় ভুগছেন ৪৭ জন। গতকাল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেওয়া জবানবন্দিতে এসব তথ্য তুলে ধরেন হাসপাতালটির রেটিনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাকিয়া সুলতানা নীলা। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় প্রসিকিউশনের ২১তম সাক্ষী হিসেবে বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১-এ তিনি জবানবন্দি দেন। গতকাল প্রসিকিউশনের ২০তম সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন একই হাসপাতালের পরিচালক ডা. খায়ের আহমেদ চৌধুরী। এ ছাড়া এদিন প্রসিকিউশনের ২২তম সাক্ষী হিসেবে জুলাই আন্দোলনে নিহত মারুফ হোসেনের বাবা ফুচকা ও চটপটি বিক্রেতা মো. ইদ্রিস, ২৩তম সাক্ষী হিসেবে লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী আমেনা আক্তার এবং প্রসিকিউশনের ২৪তম সাক্ষী হিসেবে কুমিল্লার দেবিদ্বারে গুলিতে নিহত বাসচালক আবদুর রাজ্জাকের মা হাসনে আরা বেগম তাঁর জবানবন্দি দেন ট্রাইব্যুনালে। পরে এই মামলার পলাতক আসামি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন সাক্ষীদের জেরা করেন। মামলার একমাত্র গ্রেপ্তার সাক্ষী ও রাজসাক্ষী সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন আসামির কাঠকড়ায় উপস্থিত ছিলেন।
এদিন প্রসিকিউশনের পক্ষে ট্রাইব্যুনালে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম, গাজী এমএইচ তামীম, বিএম সুলতান মাহমুদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এ মামলায় এখন পর্যন্ত ২৪ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। আরও সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আজকের দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল।
১৮ জুলাই ছিল রক্তাক্ত দিন : ডা. জাকিয়া সুলতানা নীলা তাঁর জবানবন্দিতে বলেন, ‘গত বছর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ১৭ জুলাই থেকে আমাদের হাসপাতালে রোগী আসা শুরু হয়। ওই দিন আমরা পিলেটবিদ্ধ পাঁচজন রোগী পেয়েছিলাম। ১৮ জুলাই ছিল একটি রক্তস্নাত দিন। ওই দিন দুপুরের দিকে আমার কাছে খবর আসে হাসপাতালে অনেক আহত রোগী এসেছে। প্রায় ১০০ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়। এর বাইরে আনুমানিক আরও ১০০ রোগীকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। পরে আমি জরুরি বিভাগে এসে একটি ভয়াবহ চিত্র দেখতে পাই।’
তিনি বলেন, ‘যারা হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছিল তাদের বয়স ১৪ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। তাদের কেউ কেউ এক হাত দিয়ে এক চোখ, দুই হাত দিয়ে দুই চোখ ধরে ছিল। ওই দিন রাত ৯টায় আমরা ১০টা টেবিলে অপারেশন করতে থাকি। ১৯ জুলাই প্রায় একই চিত্র দেখতে পাই। ওই দিন সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ১০টা টেবিলে অস্ত্রোপচার চলতে থাকে। আমাদের হাসপাতালে যারা চিকিৎসার জন্য এসেছিলেন তাদের অধিকাংশ পিলেট ও বুলেট দ্বারা আহত হন। অধিকাংশ রোগীর কর্নিয়া ছিদ্র হয়ে গেছে, তাদের চোখের ভিতরের সাদা অংশ ছিদ্র হয়ে যায়, অনেকের চোখ ফেটে গিয়েছিল। চোখের রেটিনায় আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ায় রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। ৪, ৫ ও ৬ আগস্ট আমরা অসংখ্য রোগী গ্রহণ করি তাদের চোখে অপারেশন করা হয়।’ তিনি বলেন, ‘ওই সময় রোগীরা ভীতসন্ত্রস্ত ছিল। নিরাপত্তার কারণে অনেক রোগী তাদের নাম-ঠিকানা গোপন করে ছদ্মনাম দিয়েছে। মোবাইল নাম্বার ভুল দিয়েছে, তাদের পরিচয় ভুল দিয়েছে।’
রামপুরা ব্রিজের ওপর গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় মারুফ : নিহত মারুফ হোসেনের বাবা ফুচকা ও চটপটি বিক্রেতা মো. ইদ্রিস জবানবন্দিতে বলেন, ‘আমার ছেলে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ত। সময় পেলেই গ্রাম থেকে ঢাকায় এসে আমাকে সহযোগিতা করত। ১৯ জুলাই সকাল সাড়ে ৯টায় আমার ছেলে মারুফ আন্দোলনের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। তার সঙ্গে ছিল তার মামা ফয়সাল। জুমার নামাজের পর তারা বাসায় ফিরে এলে একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করি। পরে সাড়ে ৩টায় আবার বের হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর তার মামা আমাকে ফোন করে জানায় যে রামপুরা ব্রিজের ওপর থেকে পুলিশ, বিজিবি ও ছাত্রলীগ আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি করছে। পৌনে ৬টার দিকে ফোন করে জানায় মারুফ গুলিবিদ্ধ হয়েছে বাড্ডা ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে। তখন তাকে এএমজেড হাসপাতালে নিয়ে যায়।’
জবানবন্দিতে ইদ্রিস বলেন, ‘মারুফের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় ঢাকা মেডিকেলে নিতে বলে সেখানকার ডাক্তাররা। পথে রামপুরা ব্রিজের ওপর আওয়ামী লীগ, পুলিশ, বিজিবি মিলে আমার ছেলেকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সটি আটকায়। তখন মারুফের শরীরে অক্সিজেন লাগানো ছিল, সে বেঁচে ছিল। ১৫-২০ মিনিট ধরে রেখে পুলিশ জানায় সে মারা গেছে, তাকে হাসপাতালে নেওয়ার দরকার নেই। আমার ছেলের গুলিবিদ্ধ স্থানটি তখন গামছা দিয়ে প্যাঁছানো ছিল। পুলিশ রাইফেলের বাঁট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দেখে। তখন আমাদের ছেলে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল।’ তিনি বলেন, ‘সেখান থেকে সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয় ছেলেকে। এরপর ৭টা ২০ মিনিটের দিকে সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।’
জবানবন্দিতে ইদ্রিস আরও বলেন, ‘ছেলের লাশ নিয়ে যেতে চাইলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পোস্টমর্টেম ছাড়া দিতে চায়নি। দুই দিন পর ২১ জুলাই পোস্টমর্টেম করে আমার ছেলের লাশ হস্তান্তর করে। পুলিশি বাধার কারণে ছেলের লাশের পোস্টমর্টেম করতে দেরি হয়েছে। বাড্ডা থানার ওসি তার এলাকায় এমন ঘটনা ঘটেনি বলে অস্বীকার করেন। পূর্ব বাড্ডার কবরস্থানে ছেলের লাশ দাফন করা হয়।’ ছেলের হত্যাকাণ্ডের জন্য নির্দেশদাতা হিসেবে শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান কামাল, চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, স্থানীয় এমপি ওয়াকিল উদ্দিন এবং মাঠে থাকা কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর আলম ও বিজিবির রেদোয়ানের বিচার চান এই সাক্ষী।
ছাত্রলীগের গুলিতে মারা যায় আফনান : লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী ২০ বছর বয়সি আমেনা আক্তার জবানবন্দিতে বলেন, ‘গত বছর ২৯ জুলাই সকাল ১০টার দিতে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা পরিষদের সামনে বাগবাড়ি মোড়ে সমবেত হই। ওই সময় ওখানে পুলিশ ও যুবলীগের লোকজন আমাদের ওপর হামলা করে। আমরা সেখান থেকে চলে যেতে বাধ্য হই।’
তিনি বলেন, ‘এরপর ৪ আগস্ট সকাল ৯টার দিকে বাগবাড়ি মোড়ে সমবেত হয়ে ৯টার সময় ঝুমুর চত্বরে আসি। ওখানে আসার পর ১২টা পর্যন্ত আমরা মিছিল করি। ওই সময় মাদাম ব্রিজ এলাকা থেকে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের ১২০-১৩০ জন সশস্ত্র অবস্থায় আমাদের ওপর হামলা করে। তারা গুলি করতে করতে আমাদের দিকে এগিয়ে আসে। তখন আমরা ৩০-৪০ জন মাদাম ব্রিজের দিকে এগিয়ে যাই।
ওখানে যাওয়ার পর বিপরীত দিক থেকে ছাত্রলীগের লোকজনের গুলিতে একজন ছাত্র গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে যায়। পরে জেনেছি তার নাম ছাদ আল আফনান। আফনান সেখানেই মারা যায়।’
সাক্ষী তার জবানবন্দিতে বলেন, ‘ওই সময় আওয়ামী সন্ত্রাসীরা আমাকে ধাওয়া করে ধরে ফেলে মারপিঠ করতে থাকে। অজ্ঞাতনামা দুজন আন্দোলনকারী আমাকে উদ্ধার করে লক্ষ্মীপুর আধুনিক হাসপাতালে নিয়ে যায়। আমি সেখানে দুই দিন চিকিৎসাধীন ছিলাম। পরে আমি বাড়ি গিয়ে শুনেছি ৪ আগস্ট আরও ৪ থেকে ৫ জন শহীদ হয়েছে। ২০০-এর বেশি আহত হয়েছে।’
এ ঘটনার জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পুলিশের সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনসহ দায়ী ব্যক্তিদের বিচার চান এই সাক্ষী।
হাসিনার ফাঁসি চাই বললেন সাক্ষী : কুমিল্লার দেবিদ্বারে গুলিতে নিহত বাসচালক আবদুর রাজ্জাকের মা ৫৫ বছর বয়সি হাসনে আরা বেগম তাঁর জবানবন্দিতে বলেন, ‘গত বছর ৪ আগস্ট সকালে আমার ছেলে রাজ্জাক নাশতা খেয়ে আন্দোলনে যায়। বেলা দেড়টার দিকে আমরা খবর পাই আমার ছেলে আহত হয়েছে দেবিদ্বার থানার বানিয়াপাড়া আজগত আলী স্কুলের কাছে। তারপর আমি সেখানে যাই। গিয়ে দেখি দুইজন মহিলা কাঁদছে। রাস্তার ওপর অনেক রক্ত পড়ে ছিল। পরে আমি সেখান থেকে দেবিদ্বার উপজেলা হাসপাতালে গিয়ে আমার ছেলের বউ ও আমার মেয়েকে দেখতে পাই। আমার ছেলেকে একনজর দেখি। তখন উপস্থিত লোকজন বলে আমার ছেলে মারা গেছে। আমি তখন অজ্ঞান হয়ে যাই। আমার ছেলের বউ ও মেয়ে আমাকে বাড়িতে নিয়ে যায়।’
জবানবন্দিতে সাক্ষী বলেন, ‘রাত ৯টার দিকে নয়ন দারোগা আমাকে ফোন দিয়ে থানায় ডেকে নিয়ে পোস্টমর্টেম করতে হবে বলে একটি কাগজে স্বাক্ষর নেয়। সেখানে আওয়ামী লীগের নেতা মোস্তাফিজুর রহমান সরকার আমাকে বলে নগদ সাত লাখ টাকা দিয়ে দিচ্ছি, দুইটা দোকান দিচ্ছি, ছেলের বউ নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবে। মামলা করার দরকার নেই। আমি টাকা নিই নাই।’
তিনি বলেন, ‘পরদিন বেলা ১২টার দিকে আমার ছেলের লাশ পোস্টমর্টেম করে বাড়িতে নিয়ে আসে। ওই দিনই জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে আমার ছেলের লাশ দাফন করি। মোবাইলে দেখেছি হাসিনা লোক দিয়ে আমার ছেলেকে মেরেছে। নৌকা পার্টির লোক সালাউদ্দিন আমার ছেলেকে গুলি করেছে। অন্যান্যরা আমার ছেলেকে কুপিয়েছে। আমার ছেলে হত্যার জন্য শেখ হাসিনার ফাঁসি চাই।’