বাংলাদেশে হৃদরোগের ঝুঁকি বিভিন্ন কারণে বাড়ছে। শুধু প্রচলিত ঝুঁকি ফ্যাক্টরগুলোর কারণে নয়, বরং কিছু নতুন এবং উদীয়মান ঝুঁকি ফ্যাক্টরও বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
প্রচলিত ঝুঁকি ফ্যাক্টর
* উচ্চরক্তচাপ (হাইপারটেনশন) : দেশের জনগণের মধ্যে উচ্চরক্তচাপ একটি সাধারণ সমস্যা। উচ্চরক্তচাপ দীর্ঘমেয়াদে থাকলে হৃদরোগের ঝুঁকি অনেক গুণ বাড়ে।
* ডায়াবেটিস (টাইপ-২) : টাইপ-২ ডায়াবেটিস বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে এবং এটি হৃদরোগের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ঝুঁকি ফ্যাক্টর। ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তিদের রক্তে শর্করা বেশি থাকায় রক্তনালি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা হার্টের সমস্যাকে প্রভাবিত করে।
* ধূমপান ও তামাক ব্যবহার : তামাক ও ধূমপান দেশে খুবই প্রচলিত, বিশেষ করে পুরুষদের মধ্যে। এটি রক্তনালিকে ব্লক করে এবং রক্তচাপ বৃদ্ধি করে, যা হার্টের রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। তামাকের ক্ষতিকর প্রভাব শুধু হার্টের ওপর নয়, পুরো শরীরের ওপর পড়ছে।
* অ্যাকটিভিটি ও শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা : শারীরিক কার্যকলাপের অভাব এবং দীর্ঘসময় বসে থাকার জীবনযাত্রা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়াতে সহায়তা করে। বসে থাকার কারণে শরীরে অতিরিক্ত মেদ জমে এবং শরীরের বিপাকীয় কার্যক্রম সঠিকভাবে চলে না, যা হৃদরোগের অন্যতম কারণ।
* নতুন ঝুঁঁকি ফ্যাক্টর
* আর্সেনিক দূষণ : বাংলাদেশের বহু অঞ্চলে আর্সেনিকের উপস্থিতি রয়েছে, বিশেষ করে মাটির পানি এবং খাদ্যে। আর্সেনিক একটি পরিচিত বিষাক্ত পদার্থ, যা দীর্ঘমেয়াদে সেবনে রক্তনালিতে ক্ষত সৃষ্টি করে এবং হার্টের সমস্যার সৃষ্টি করে।
* বায়ু দূষণ : ঢাকা এবং অন্য বড় শহরে বায়ুদূষণ গুরুতর একটি সমস্যা। বিশেষ করে পিএম২.৫ কণাগুলোর উচ্চমাত্রা হৃদরোগীদের জন্য ক্ষতিকর। এ ক্ষুদ্র কণাগুলো শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবাহিত হয়ে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায় এবং সঠিকভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে সমস্যা সৃষ্টি করে।
* পুষ্টির অভাব : বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে পুষ্টির অভাব সাধারণ একটি সমস্যা। বিশেষ করে ভিটামিন ডি এবং জিংকের অভাব হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। পুষ্টির অভাব হৃদযন্ত্রের কার্যক্ষমতাকে প্রভাবিত করে এবং এটি রক্তনালিরও ক্ষতি করে।
বর্তমানে চিকিৎসা সুযোগ
বর্তমানে, বাংলাদেশে হৃদরোগের চিকিৎসা ক্ষেত্রটি অনেক উন্নত হয়েছে এবং বিভিন্ন আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে নিম্নলিখিত চিকিৎসা পদ্ধতিগুলো অন্যতম-
* ইসিজি : এসিজি একটি অত্যন্ত সাধারণ এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি যা হৃৎপিন্ডের বৈদ্যুতিক কার্যকলাপ পরিমাপ করে। এটি হৃদরোগের অনেক প্রাথমিক চিহ্ন শনাক্ত করতে সহায়তা করে, যেমন অ্যারিথমিয়া বা মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন।
* ইকোকার্ডিওগ্রাফি : ইকোকার্ডিওগ্রাফি বা ইকো হৃৎপিন্ডের গঠন এবং কার্যকারিতা মূল্যায়ন করার জন্য ব্যবহৃত একটি প্রযুক্তি। এটি হৃৎপিন্ডের আকার, স্তরের গতি এবং মাংসপেশির কার্যকারিতা বিশ্লেষণ করতে সহায়ক।
* স্ট্রেস টেস্ট : স্ট্রেস টেস্ট হৃৎপিন্ডের সঞ্চালন সক্ষমতা এবং সঠিক কার্যকারিতা পর্যালোচনা করার জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি রোগীর হৃদরোগের ঝুঁকি পরীক্ষা করতে সহায়তা করে এবং শারীরিক চাপের মধ্যে হৃৎপিন্ডের প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করা হয়।
* সিটি অ্যাঞ্জিওগ্রাফি : সিটি অ্যাঞ্জিওগ্রাফি আধুনিক প্রযুক্তি যা রক্তনালির মধ্যে কোনো বাধা বা সংকোচনের উপস্থিতি শনাক্ত করতে সহায়তা করে। এটি কনভেনশনাল করোনারি অ্যাঞ্জিওগ্রাফির তুলনায় অনেক নিরাপদ, এবং এটি করতে কম সময় নেয়।
ইনভেসিভ চিকিৎসা
পারকিউটেনিয়াস করোনারি ইন্টারভেনশন (PCI)) : পারকুটেনিয়াস করোনারি ইন্টারভেনশন (PCI)) বা এনজিওপ্লাস্টি একটি ইনভেসিভ চিকিৎসা পদ্ধতি যা করোনারি আর্টারি ব্লক সরানোর জন্য ব্যবহৃত হয়।
করোনারি বাইপাস গ্রাফটিং (CABG) : এটি একটি সলিড এবং পরীক্ষিত সার্জিক্যাল চিকিৎসা পদ্ধতি যেখানে বন্ধ বা সংকুচিত করোনারি আর্টারি বাইপাস করা হয়। এটি গুরুতর হৃদরোগের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়, বিশেষ করে যেখানে PCI) সম্ভব নয়।
অন্য আন্ত্রিক অস্ত্রোপচার ইন্টারভেনশন : আরও কিছু উন্নত আন্ত্রিক অস্ত্রোপচার এবং শল্যচিকিৎসা ব্যবস্থা সহজলভ্য। এসব পদ্ধতি হৃদযন্ত্রের নানা ধরনের সমস্যা যেমন, হৃৎপিন্ডের পাম্পিং ক্ষমতা দুর্বল হওয়া, মাইট্রাল বা অ্যাওরটিক ভালভ সমস্যা এবং অন্য রোগের জন্য ব্যবহার করা হয়।
পরিশেষে : হৃদরোগ সম্পর্কিত আরও গবেষণা করা জরুরি, যা বাংলাদেশে এ রোগের প্রকৃত কারণ এবং ঝুঁকি ফ্যাক্টর সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রদান করবে। এর মাধ্যমে এ ধরনের রোগের পূর্বাভাস এবং প্রতিরোধের উপায় খুঁজে বের করা সম্ভব হবে, যা ভবিষ্যতে এ রোগ থেকে জনগণকে রক্ষা করতে সহায়ক হবে। বিশেষ করে, জেনেটিক, পরিবেশগত এবং জীবনযাত্রার প্রভাব নিয়ে গবেষণা আরও ব্যাপক করা উচিত। পাশাপাশি, রোগের চিকিৎসা এবং প্রতিরোধ সম্পর্কিত পরামর্শ, প্রোটোকল এবং গাইডলাইনগুলো তৈরি ও বাস্তবায়ন করা উচিত।
লেখক : মেডিসিন ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ, মেডিনোভা মেডিকেল সার্ভিসেস, মালিবাগ, ঢাকা।