কেউ তৈরি করছেন বসতঘরের দরজা জানালা, কেউ ফ্রেম আবার কেউ তৈরি করছেন দেয়াল। সবশেষে দক্ষ শ্রমিকদের নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় রং পালিশের শেষ হচ্ছে নান্দনিক ও পরিবেশবান্ধব কাঠের বসতবাড়ি। ঘরের ভিতরে-বাইরে এমন সুন্দর কারুকাজ, যা প্রথম দৃষ্টিতেই আকর্ষণ করে। এমন দৃশ্য দেখা যায় বাগেরহাট সদর উপজেলার প্রত্যন্ত কররী গ্রামের একটি ফার্নিচারের কারখানায়। বাগেরহাট-খুলনা মহাসড়কের সিএন্ডবি বাজারসংলগ্ন এ গ্রামের ন্যাচারাল ফাইবার নামের কারখানায় তৈরি ঘরগুলো রপ্তানি করা হবে ইউরোপের দেশ বেলজিয়ামের পাইরি ডাইজা ইকো পার্কে। আশপাশের এলাকা থেকে সংগ্রহ করা কাঠ দিয়ে বসতবাড়ি তৈরি হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটিতে।
কাঠের তৈরি এ বাড়ির কাঠামো, দেয়াল, দরজা-জানালা এমনকি ছাদও কাঠের তৈরি। প্রথমে কাঠ কেটে ও সাইজ করে পুরো বাড়িটি তৈরি করে শ্রমিকরা। বাড়িটি ১১ মিটার লম্বা এবং চওড়া সোয়া ৪ মিটার। সম্পূর্ণ কাঠের তৈরি। এরপর বিভিন্ন অংশকে ছোট আকারে খণ্ড খণ্ড করা হয়। ফলে পুরো বাড়িটিকে স্বল্প স্থানে সহজে পরিবহন করা যায়। পরবর্তীতে এ খণ্ডাংশগুলো জুড়ে যে কোনো জায়গায় স্থাপন করা সম্ভব। ন্যাচারাল ফাইবার প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা মোস্তাফিজ আহমেদ বলেন, পরিবেশের ক্ষতি করে না এমন পণ্য ব্যবহার করে ইউরোপের দেশ বেলজিয়াম থেকে চলতি বছরের প্রথমদিকে কাঠের ঘর যাচ্ছে ইউরোপে। ১২০টি বসতবাড়ি তৈরির অর্ডার পান বাগেরহাট বিসিক শিল্পনগরীর উদ্যোক্তা মোস্তাফিজ। এরপর থেকে পরিবেশবান্ধব বসতবাড়ির তৈরির উদ্যোগ নেন তিনি।
ব্যবসায়ী মোস্তাফিজ আহমেদ বলেন, বেলজিয়ামের একটি ইকোপার্কের জন্য বায়াররা অর্ডার দিয়েছে। পরিবেশবান্ধব কাঠের তৈরি এ রকম ১২০টি বসতঘর তাদের প্রয়োজন, যা আগামী দুই বছরের মধ্যে বেলজিয়ামে পাঠানো হবে। তাঁর ভাষায় আমাদের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাদের চুক্তি হয়েছে, দেশি মেহগনি কাঠ দিয়ে এ ঘরগুলো তৈরি করতে হবে। এ ছাড়া, এসব বাড়ির কাঁচামাল পরিবেশে মিশে যায় এমন হতে হবে। পরিবেশের ক্ষতি হয়, এমন কোনো পণ্য ব্যবহার করা যাবে না। পরিবেশবান্ধব এ বাড়ি রপ্তানির মাধ্যমে নতুন বাজার সৃষ্টি, কর্মসংস্থান তৈরি ও বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের নতুন পথ উন্মোচিত হতে যাচ্ছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এ উদ্যোগ আরও একধাপ এগিয়ে যাবে।
প্রথমবারের মতো নিজ দেশের এ পণ্য ইউরোপের বাজারে রপ্তানিতে সম্পৃক্ত থাকতে পেরে শ্রমিকরাও খুশি। কাঠমিস্ত্রি মোজাহিদ বলেন, ‘আমাদের প্রথমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তারপর ডিজাইন দেখে সম্পূর্ণ একটি বসতঘর তৈরি করেছি। এরপর কোম্পানি ও বিদেশি লোকজন দেখে পছন্দ করছে। এখন আমরা পুরোদমে কাজ শুরু করেছি। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে প্রতিটি বসতঘর তৈরি করতে এক সপ্তাহ সময় লাগে। প্রায় ২০০ জন শ্রমিক এ বাড়ি তৈরির কাজ করছেন। কারখানার শ্রমিক শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা আগে কখনো এ ঘর তৈরি করিনি। এখন দেখছি খুবই সুন্দর হয়েছে ঘরগুলো। সম্পূর্ণ কাঠ দিয়ে এভাবে ঘর তৈরি করা যায় কখনো ভাবতেও পারিনি। দুটি বেডরুমে মোট পাঁচজন থাকার উপযোগী এ ঘর সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। ঘরের এক পাশে একটি বারান্দা, বেডরুমের সঙ্গে বাথরুম ও বসার ঘর রয়েছে। বসার ঘরে টেলিভিশন দেখার ব্যবস্থা এবং ঘরের ভিতরেই রান্না করারও ব্যবস্থা রাখা কাঠের ঘর তৈরি হয়েছে। ঘরের প্রতিটা অংশ খুলে প্যাকিং করে পাঠানো হবে বেলজিয়াম।
সাইফুল নামের অপর এক শ্রমিক বলেন, ‘আমাদের হাতে তৈরি কাঠের ঘর বিদেশে যাচ্ছে, এটা আমাদের জন্য গর্বের। আমরা এ ঘর তৈরি করতে পেরে খুবই আনন্দিত। কথায় কথায় জানা গেল, চলতি বছরের শুরুর দিকে গ্রিসের কোকোম্যাট নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বেলজিয়াম থেকে কাঠের ঘর তৈরির অর্ডার পায় বাগেরহাটের ন্যাচারাল ফাইবার নামক প্রতিষ্ঠানটি। এরপর থেকে কাঠের ঘরের স্যাম্পল তৈরি শুরু হয় প্রতিষ্ঠানটিতে। কাঠের তৈরি স্যাম্পল ঘরটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের পছন্দ হওয়ায় চুক্তি অনুযায়ী আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৫ সালের জুন মাসের মধ্যে ১২০টি ঘর তৈরি করে রপ্তানির জন্য কাজ শুরু করে। পাইরি ডাইজা ইকোপার্কের প্রধান স্থপতি পেসেল ডি বেক বলেন, আমরা এখানে এসেছি কারণ আমরা খুঁজে পেয়েছি এখানের মানুষ কারুশিল্পে দক্ষ।