বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের সংকট মেটাতে মার্কিন কৌশলগত জরুরি তেলের রিজার্ভ খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তবে আমেরিকার এই সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে সৌদি আরব। রিয়াদ বলেছে, তেলের বাজারে ‘কারসাজি করতে’ এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
কোথায় মার্কিন তেলের ভাণ্ডার?
এই মজুত আছে টেক্সাস এবং লুইজিয়ানা অঙ্গরাজ্যে মাটির নিচে লবণের স্তরের ভেতর তৈরি গুহায়। এখানে যুক্তরাষ্ট্রের কোনও জরুরি প্রয়োজন সামাল দেবার জন্য জমা করে রাখা আছে বিপুল পরিমাণ তেল।
যুক্তরাষ্ট্রে মোট চারটি জায়গায় এই জরুরি তেলের মজুত রয়েছে। টেক্সাসের ফ্রিপোর্ট এবং উইনির কাছে, আর লুইজিয়ানায় লেক চার্লস আর ব্যাটন রুজে।
মাটির তিন হাজার তিনশ’ ফিট নিচে মানবসৃষ্ট অনেকগুলো গুহার মধ্যে এই তেল জমা করে রাখা আছে। ভূগর্ভস্থ লবণের স্তরের একটা অংশের লবণ গলিয়ে ফেলে তৈরি করা হয় এই গুহা- যাতে প্রাকৃতিক গ্যাস বা তেল মজুত রাখা যায়।
মাটির ওপরে ট্যাংকে তেল জমা রাখার চাইতে এই পদ্ধতি অনেক সস্তা, এবং নিরাপদ। ভূগর্ভস্থ লবণের রাসায়নিক গঠন এবং ভূতাত্বিক চাপ - দুই কারণেই এখান থেকে তেল বেরিয়ে যেতে পারে না।
ফ্রিপোর্টের কাছে ব্রায়ান মাউন্ডে যে গুহাটি আছে তাদের ২৫৪ মিলিয়ন বা ২৫ কোটি ৪০ লাখ ব্যারেল তেল জমা রাখা যায়।
আসলে সেই তেলের মজুত গড়ে তোলার ভাবনাচিন্তা করা হয়েছিল ১৯৭০-এর দশকে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময়কার তেল সংকটের পটভূমিতে।
আন্তর্জাতিক জ্বালানি এজেন্সির সব সদস্য দেশকেই অন্তত ৯০ দিন ব্যবহারের মত পেট্রোলিয়ামের আমদানি ধরে রাখতে হয়। তবে জরুরি প্রয়োজন মোকাবিলার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে ভাণ্ডার গড়ে তুলেছে- তার মত বড় মজুত পৃথিবীর আর কোথাও নেই।
কেন এই জরুরি তেলের মজুত?
১৯৭০ এর দশকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর তেল নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে সারা পৃথিবীতেই তেলের দাম আকাশছোঁয়া হয়ে গিয়েছিল।
১৯৭৩-এর আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের পক্ষ নেওয়ায় ওপেকের সদস্য ইরাক, কুয়েত, কাতার ও সৌদি আরব আমেরিকায় তেল রফতানি করতে অস্বীকার করে।
যদিও আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ মাত্র তিন সপ্তাহেই থেমে যায়। কিন্তু সেই নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল ১৯৭৪-এর মার্চ পর্যন্ত।
ফলে তেলের দাম বেড়ে গিয়েছিল প্রায় চারগুণ- ব্যারেল প্রতি ৩ ডলার থেকে ১২ ডলারের কাছাকাছি। পেট্রোলপাম্পগুলোয় পড়ে গিয়েছিল গাড়ির দীর্ঘ লাইন।
এরপরই ভবিষ্যতের সংকট মোকাবিলার চিন্তা থেকে মার্কিন কংগ্রেসে একটি আইন পাস করে কৌশলগত পেট্রোলিয়াম রিজার্ভ গড়ে তোলা হয় ।
কত দিন চলবে এই মজুতে?
চলতি বছরের মার্চে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা ‘রয়টার্স’ জানিয়েছে, তখন আমেরিকার ওই ভাণ্ডারে মজুত ছিল ৫৮৬ মিলিয়ন ব্যারেল তেল।
স্ট্যাটিস্টার তথ্যানুযায়ী, ২০২২ সালের চলতি অক্টোবরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দৈনিক জ্বালানি ব্যবহারের পরিমাণ ছিল প্রায় ৮.৭ মিলিয়ন ব্যারেল।
সে হিসেবে বর্তমানে যা মজুত আছে তা দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনায়াসে ৬৭ দিন চলতে পারবে।
এর আগে এই তেল কি কখনও ব্যবহার হয়েছে?
বিবিসির এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১১ সালে জরুরি মজুতের তেল ব্যবহার করা হয়েছিল, যখন আরব বসন্তের কারণে জ্বালানি সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়েছিল।
১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ সিনিয়র জরুরি মজুতের তেল ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিলেন।
তার ছেলে প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ হারিকেন ক্যাটরিনার পর জরুরি মজুতের ১ কোটি ১০ লাখ ব্যারেল তেল বিক্রির অনুমতি দেন।
প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সময়ও বাজেট ঘাটতি কাটাতে ১৯৯৭ সালে ২ কোটি ৮০ লাখ ব্যারেল তেল বিক্রি করা হয়।
অনেকে অবশ্য এত বড় জরুরি মজুত রাখার আদৌ প্রয়োজন আছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ২০১৭ সালে জরুরি মজুতের অর্ধেক তেলই বিক্রি করে দেবার পরিকল্পনা করেছিলেন ফেডারেল ঘাটতি কমানোর লক্ষ্যে। সূত্র: রয়টার্স, বিবিসি, স্ট্যাটিস্টা
বিডি প্রতিদিন/কালাম