নবী করিম (সা.)-এর অসাধারণ রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার প্রথম বড় পরীক্ষা মদিনায় অনুষ্ঠিত হয়। তিনি অত্যন্ত প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিজের প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার মাধ্যমে নিরাপত্তার এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পথ বের করেন। মদিনায় এসে তিনি সমাজ এবং নাগরিক জীবনের পুনর্গঠনে মনোনিবেশ করেন। এখানে তিনি রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা ও ঐক্য প্রতিষ্ঠায় অসাধারণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। (ইনসানে কামেল, পৃষ্ঠা-৩৬৬)
তাঁর সব প্রচেষ্টার একমাত্র লক্ষ্য ছিল আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করা এবং মানুষকে আল্লাহর বিধানের প্রতি সমর্পিত করা। (আহদে নববী মেঁ নিজামে হুকমিরানি, পৃষ্ঠা-২৯৫)
মদিনায় আসার পর দ্বিতীয় প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল মুসলমানদের পুনর্বাসন এবং সমাজে তাদের সংহতি ও ঐক্য প্রতিষ্ঠা। মদিনার আনসাররা ছিল একটি শক্তিশালী স্থানীয় সম্প্রদায়, আর নবী করিম (সা.)-এর সঙ্গে মক্কা থেকে আসা মুহাজির মুসলমানদের পুনর্বাসন একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি যে মুয়াখাত বা ভ্রাতৃত্বব্যবস্থা চালু করেন, তা ছিল তাঁর অসাধারণ রাজনৈতিক প্রজ্ঞার এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
এই ভ্রাতৃত্বব্যবস্থা শুধু মুসলিম সমাজের ভিত্তিকে দৃঢ় করেই থেমে থাকেনি, বরং মুসলমানদের মধ্যে এমন ঐক্য ও সংহতি সৃষ্টি করে, যা বাইরের আক্রমণের বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করেছিল।
(তাবাকাতুল কুবরা, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-২৩৯)
নবী করিম (সা.)-এর এই উদ্যোগ শুধু সময়ের নিরিখে একটি রাজনৈতিক পদক্ষেপ ছিল না, বরং এটি মানবতার ইতিহাসে সামাজিক ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার এক অতুলনীয় উদাহরণ। তাঁর এই উদ্যোগে এমন ঐক্যের ভিত্তি স্থাপন হয়েছিল, যা সে সময় আরবদের কল্পনায়ও ছিল না। এই ভ্রাতৃত্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মদিনায় থাকা মুসলমানদের মধ্যে এক অটুট সংহতি সৃষ্টি হয়।
নবী করিম (সা.)-এর চিন্তাশক্তির গভীরতা এবং নেতৃত্বের অসাধারণ গুণাবলির কারণে সব বুদ্ধিজীবী তাঁর নেতৃত্বের সামনে মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছিলেন। [হায়াতে মুহাম্মদ (সা.), পৃষ্ঠা-৪৮১]
এই ভ্রাতৃত্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নবী করিম (সা.) এমন একটি শক্তিশালী সমাজ গড়ে তুলেছিলেন, যা মদিনার অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র এবং বাইরের আক্রমণ উভয়ের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে এই ঐক্য প্রতিকূলতা মোকাবেলায় মজবুত ভিত্তি গড়ে দেয়।
ভ্রাতৃত্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পর নবী করিম (সা.) শান্তি ও স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে অনেকটা স্বস্তি অনুভব করেন। কারণ মদিনায় থাকা অশুভ শক্তি, বিশেষত মুনাফিকরা আউস ও খাজরাজ গোত্রের মধ্যে বিভেদ তৈরি করতে চেষ্টা চালাচ্ছিল।
একই সঙ্গে তারা মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে বৈরিতা ছড়ানোর অপচেষ্টা করছিল। কিন্তু ভ্রাতৃত্ব চুক্তির ফলে তাদের এই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়ে যায়। [হায়াতে মুহাম্মদ (সা.), পৃষ্ঠা-৪৮৪]
এমন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে এই ভ্রাতৃত্ব চুক্তির রাজনৈতিক ও সামাজিক গুরুত্ব অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই, বিশেষত মুনাফিক নেতা আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের মতো ব্যক্তিরা, যে নবী করিম (সা.)-এর আগমনের আগে মদিনার সম্ভাব্য রাজা ছিল, মুসলমানদের ঐক্য নষ্ট করতে তৎপর ছিল। কিন্তু নবী করিম (সা.)-এর অসাধারণ প্রজ্ঞা, রাজনৈতিক কৌশল ও দূরদর্শিতার মাধ্যমে মুসলমানদের মধ্যে এমন ঐক্য ও সংহতি সৃষ্টি হয়েছিল যে মুনাফিক ও ইহুদিদের সব চক্রান্ত ব্যর্থ হয়ে যায়। (সিরাতুন নববী, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-২৩২)
এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে নবী করিম (সা.) শুধু একটি শক্তিশালী সমাজ প্রতিষ্ঠাই করেননি, বরং মুসলিম সমাজকে এক অটুট ও অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ করেছিলেন, যা ইতিহাসে চিরকালীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন