দক্ষিণ-পশ্চিম ইউরোপের স্থলবেষ্টিত ছোট্ট দেশ অ্যান্ডোরা। ফ্রান্স ও স্পেনের মধ্যবর্তী পিরেনীয় পর্বতমালার কোলে এর অবস্থান। অ্যান্ডোরার দাফতরিক নাম ‘প্রিন্সিপালিটি অব অ্যান্ডোরা’। ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি ও স্পেনের উরজেল বিশপ যৌথভাবে অ্যান্ডোরা শাসন করেন।
তবে প্রধানমন্ত্রীই দেশের অভ্যন্তরীণ নির্বাহী ক্ষমতা সংরক্ষণ করেন। ইউরোপের ক্ষুদ্রতম রাষ্ট্রের তালিকায় অ্যান্ডোরার অবস্থান ষষ্ঠ। এর আয়তন মাত্র ৪৬৮ বর্গকিলোমিটার। অ্যান্ডোরা মূলত আইবেরীয় উপদ্বীপের পার্বত্য অঞ্চল।
পার্বত্য ভূমি, উপত্যকা, নদী ও সবুজ বনই দেশটির বৈশিষ্ট্য। অ্যান্ডোরার অর্থনীতি পর্যটননির্ভর। প্রতি বছর বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে ৮০ লাখ পর্যটক এখানে আগমন করে। শুষ্কমুক্ত লেনদেন অ্যান্ডোরার অর্থনীতিকে গতিশীল করেছে বলে ধারণা করা হয়।
‘অ্যান্ডোরা লা ভেল্লা’ দেশটির রাজধানী, যা ইউরোপের উচ্চতম রাজধানী হিসেবেই পরিচিত। দেশটির মোট জনসংখ্যা ৮৫ হাজার। যার বেশির ভাগই খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী। ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউয়ের তথ্য মতে, অ্যান্ডোরায় দুই হাজার ২২৪ জন মুসলমান বাস করে, যা মোট জনসংখ্যার ২.৬ শতাংশ। দেশটিতে বসবাসরত মুসলমানের প্রায় শতভাগই সুন্নি মতাদর্শে বিশ্বাসী।
প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষকদের মতে, অ্যান্ডোরায় সাড়ে ৯ হাজার বছর আগে মানুষের আগমন ঘটেছিল। তখন মূলত ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষ এখানে শিকার করতে আসত। আর খ্রিষ্টপূর্ব ৬৫০০ অব্দে এখানে স্থায়ীভাবে মানুষের বসবাস শুরু হয়। খ্রিষ্টপূর্ব ১৯ সালে রোমানরা অ্যান্ডোরা দখল করে এবং ৪৭৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তারা দেশটি শাসন করে। রোমানদের কাছ থেকে জার্মান বংশোদ্ভূত ভিসিগথরা অ্যান্ডোরার দখল নেয়। তাদের সঙ্গেই মুসলিম বাহিনীর সংঘাত হয়। খণ্ডকালীন মুসলিম শাসনের পর দেশটি ফ্রান্সের দখলে চলে যায়। ১৮১৪ সালে স্বাধীনতা (অধিকতর স্বশাসন) লাভের আগ পর্যন্ত দেশটি ফ্রান্সের প্রত্যক্ষ শাসনাধীন ছিল। ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৩ সালে গণভোটের মাধ্যমে অ্যান্ডোরার সংবিধান কার্যকর হয়।
৭১১ খ্রিস্টাব্দে ভিসিগথ রাজা রডারিককে পরাজিত করে মুসলিম বাহিনী স্পেন জয় করে। ৭১৫ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম বাহিনী অ্যান্ডোরা জয় করে। মুসলিম বাহিনী সর্বপ্রথম অ্যান্ডোরার সিগরি উপত্যকা জয় করেছিল। মুসলমানরা ৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় ৮৫ বছর দেশটি শাসন করে। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের দাবি, অ্যান্ডোরায় মুসলিম শাসন ২০০ বছর স্থায়ী হয়েছিল। তারা সম্ভবত অ্যান্ডোরার অংশবিশেষের ওপর মুসলিম শাসকদের নিয়ন্ত্রণ ও অব্যাহত অভিযানগুলোর সময়কেও হিসাবভুক্ত করেছেন।
মূলত অ্যান্ডোরায় মুসলিম শাসন ছিল অস্থিতিশীল। মুসলিম বাহিনী পুরো অ্যান্ডোরাও বিজয় করতে পারেনি। মুসলিম বাহিনী পর্বতসংকুল ভূমি ও বৈরী প্রকৃতি এবং ভৌগোলিকভাবে কম গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণে অ্যান্ডোরার প্রতি খুব বেশি আগ্রহী ছিল না। তারা এই অঞ্চল অতিক্রম করে আধুনিক ফ্রান্সের সীমানায় প্রবেশ করতে চেয়েছিল। কিন্তু সামরিকভাবে সাফল্য না পাওয়ায় তারা আইবেরীয় অঞ্চলের সমতল ভূমির দিকে মনোযোগ দেয়। এছাড়া, ফ্রাংকিশ শাসকরা ইউরোপের অন্য দেশগুলোর সাহায্যে অ্যান্ডোরাসহ মুসলিম স্পেনের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে ‘যুদ্ধাঞ্চল’ গড়ে তুলেছিল। যেন মুসলিম বাহিনী ইউরোপের মূল ভূখণ্ডে প্রবেশ করতে না পারে। এটাও অ্যান্ডোরায় মুসলিম শাসন স্থায়ী না হওয়ার একটি রাজনৈতিক কারণ।
মুসলিম শাসনাবসানের পর থেকে ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত অ্যান্ডোরায় মুসলিম উপস্থিতির সুনির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। ১৯৭০ সালের পর দেশটিতে মুসলমানের সংখ্যা বাড়তে থাকে। বর্তমানে দেশটিতে প্রায় আড়াই হাজারের মতো মুসলমান বাস করে। যাদের বেশিরভাগ উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে আগমন করেছে। অ্যান্ডোরা সাংবিধানিকভাবে ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা বললেও দেশটিতে মুসলমানদের কোনো ধর্মীয় স্থাপনা গড়ে তোলার অনুমতি নেই। বারবার চেষ্টা করেও মুসলিমরা মসজিদ ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার অনুমতি পায়নি, সরকার তাদের জমি বরাদ্দ দিতে অস্বীকার করেছে।
অ্যান্ডোরায় একটি মুসলিম সাংস্কৃতিক কেন্দ্র আছে, যা একই সঙ্গে নামাজের স্থান ও মাদ্রাসা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ৫০ জন শিক্ষার্থী এখানে লেখাপড়া করে। পাশাপাশি এখানে বিভিন্ন সময়ে ধর্মবিষয়ক কর্মশালা ও বক্তৃতার আয়োজন করা হয়। এখানে জুমা ও ঈদের নামাজ আদায় করতে লোকজন সমবেত হয়। ২০০২ সালে রাজধানী অ্যান্ডোরা লা ভেল্লার একটি পরিত্যক্ত গির্জা কিনে এই মুসলিম সাংস্কৃতিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ১৪ জুন ২০০২ অ্যান্ডোরা সরকার মুসলিম সাংস্কৃতিক কেন্দ্রকে একটি অলাভজনক সাংস্কৃতিক সংস্থা হিসেবে নিবন্ধন দেয়। এছাড়া, দেশটিতে অনিবন্ধিত একাধিক নামাজঘর আছে বলে অনুমান করা যায়।
তথ্যসূত্র : দাওয়াহ ডট সেন্টার, আল-আইন ডটকম ও উইকিপিডিয়া