সন্তান প্রত্যেক মা-বাবার হৃদয়ের স্পন্দন। ভবিষ্যতের কাণ্ডারি এবং সমাজের নির্মাতা। একজন মুসলিম অভিভাবক শুধু সন্তানকে দুনিয়াবি সফলতা নয়, বরং পরকালের সাফল্যের পথেও পরিচালিত করতে চায়। আর এ উদ্দেশ্যে সন্তানকে সঠিক উপদেশ প্রদান এবং চারিত্রিক গঠনে দিকনির্দেশনা দেওয়া অন্যতম দায়িত্ব।
মুসলিম মনীষীদের জীবনচরিতে আমরা দেখি, তাঁরা সন্তানদের প্রতি কতটা গভীর ভালোবাসা, প্রজ্ঞা ও দ্বিনদারি মনোভাব নিয়ে উপদেশ দিতেন। তাদের প্রতিটি বাক্যে থাকত ঈমানি দরদ, দুনিয়া ও আখিরাতের ভারসাম্য এবং পূর্ণাঙ্গ মানুষ গঠনের প্রয়াস। পবিত্র কোরআনের সুরা লুকমানে বর্ণিত সন্তানের প্রতি লুকমান হাকিমের প্রদত্ত উপদেশমালা তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
ইবনু কুদামা (রহ.) বলেন, পিতার করণীয় হলো নিজ সন্তানকে অশ্লীল বাক্য বলা থেকে বিরত রাখায় অভ্যস্ত করে তোলা এবং যারা এমন কাজে লিপ্ত হয় তাদের সঙ্গে মেলামেশা করতে না দেওয়া।
কারণ বাচ্চাদের রক্ষণাবেক্ষণের মূল জায়গাটা হলো তাদের অসৎসঙ্গ থেকে রক্ষা করা। এ ছাড়া পিতার করণীয় হলো তাকে বেশি কথা না বলা এবং মনোযোগ দিয়ে শুনতে অভ্যস্ত করে তোলা, বিশেষত যদি তার চেয়ে মর্যাদাবান কেউ কথা বলে। (ইবনু কুদামা, মুখতাসারু মিনহাজিল কাসিদিন, পৃষ্ঠা-২০)
ইবনুল জাওজি (রহ.) বলেন, মেয়ের পিতা-মাতা এবং পরিবারের উচিত তারা যেন কখনো মেয়েকে তার স্বামীর ওপর নিজেকে প্রাধান্য দিতে না বলে। মেয়ের পিতা-মাতার উচিত তাকে স্বামীর অধিকারসমূহ শিখিয়ে দেওয়া, বিশেষ করে মায়ের উচিত (এ ব্যাপারে) তাকে অধিক পরিমাণে উপদেশ দেওয়া।
(ইবনুল জাওজি, আহকামুন নিসা পৃষ্ঠা-১০১)
অল্পে তুষ্টির উপদেশ
আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) তাঁর পিতা উমর (রা.)-এর কাছে এসে বললেন, আব্বা! আমাকে একটি চাদর কিনে দিন। তখন উমর (রা.) বললেন, ‘হে বৎস! তুমি তোমার কাপড় উল্টিয়ে পরিধান করো। আর তুমি ওই সব লোকের মতো হয়ো না, যারা আল্লাহর দেওয়া রিজিক পেটেও ব্যবহার করে, পিঠেও ব্যবহার করে।’ (আহমাদ ইবনে হাম্বল, কিতাবুজ জুহদ, পৃষ্ঠা-১৫৮)
সৎসঙ্গ গ্রহণ ও অসৎ সঙ্গ বর্জনের উপদেশ
আলী ইবনুল হাসান (রহ.) তাঁর পুত্রকে বলেন, ‘হে বৎস! পাপী লোকের সঙ্গে বন্ধুত্ব কোরো না; সে তোমাকে এক বেলার খাবারের বিনিময়ে বা তার চেয়েও কম মূল্যে বিক্রি করে দেবে। সে এমন কিছুর লোভ করবে, যা সে আদৌ পাবে না।
আর তুমি কৃপণ ব্যক্তির সঙ্গেও মিশবে না; কারণ যখন তোমার (বিপদ-আপদে) অর্থ-কড়ির খুব প্রয়োজন হবে, তখন সে তোমাকে নিরাশ করবে। আর তুমি মিথ্যাবাদীর সঙ্গেও থেকো না; সে মরীচিকার মতো দূরের জিনিসকে তোমার কাছে নিয়ে আসবে, আর নিকটবর্তী জিনিস থেকে তোমাকে দূরে ঠেলে দেবে। তুমি মূর্খের সঙ্গেও থেকো না; কেননা সে তোমাকে উপকার করতে চাইবে, কিন্তু শেষমেশ তোমারই ক্ষতি করে বসবে। অতঃপর আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীর সঙ্গেও মিশবে না; কেননা সে আল্লাহর কিতাবে অভিশপ্ত। (ইবনু কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ১২/৪৮৫)
কথার গোপনীয়তা রক্ষার উপদেশ
আনাস ইবনে মালেক (রা.) বলেন, আমি একদিন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছ থেকে বের হয়ে আমার বাড়ির দিকে যাচ্ছিলাম। পথে কিছু বাচ্চা খেলছিল, তাদের খেলা দেখে ভালো লাগায় আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। এমন সময় রাসুলুল্লাহ (সা.) সেখানে এসে উপস্থিত হয়ে শিশুদের সালাম দিলেন এবং আমাকে একটি প্রয়োজনীয় কাজে পাঠালেন। ফলে আমি বাসায় ফিরতে দেরি করে ফেললাম। আমার মা জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাবা! আজ ফিরতে দেরি হলো কেন? আমি বললাম, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাকে একটি কাজে পাঠিয়েছিলেন।’ তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোন কাজে?’ আমি বললাম, ‘মা! এটি একটি গোপন বিষয়।’ তখন মা বললেন, ‘বৎস! রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর গোপন কথা গোপন রাখো।’
সচ্চরিত্র গঠনের উপদেশ
আহনাফ ইবনে কায়েস (রহ.) স্বীয় সন্তান শাবিকে উপদেশ দিয়ে বলেন, ‘হে শাবি! এমন আট শ্রেণির মানুষ আছে, তারা যদি অপমানিত-অপদস্থ হয়, তবে যেন নিজেদের ছাড়া অন্য কাউকে দোষ না দেয়। এই আট শ্রেণির মানুষ হলো—
১. যে ব্যক্তি এমন কোনো দাওয়াতে চলে যায়, যেখানে তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।
২. যে ব্যক্তি দুজন লোকের ব্যক্তিগত আলাপে জোর করে ঢুকে পড়ে, অথচ তারা তাকে আলাপে যুক্ত করেনি।
৩. যে নিজের স্বার্থে কারো ঘরে বসেই সেই গৃহস্বামীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।
৪. যে ব্যক্তি নিজের প্রভাব খাটিয়ে শাসকের নিকট নিজেকে জোর করে উপস্থাপন করে।
৫. যে ব্যক্তি এমন কোনো আসনে বসে, যার সে যোগ্য নয়, অথচ নিজেকে উপযুক্ত ভাবতে থাকে।
৬. যে এমন কাউকে কথা শোনাতে চায়, যে তার কথা শুনতেও চায় না, শুনলেও মূল্য দেয় না।
৭. যে ব্যক্তি কৃপণের দান ও উপকারের আশা করে, যার হৃদয়ে উদারতার লেশমাত্র নেই।
৮. আর যে তার দরকারের কথা এমন শত্রুর কাছে প্রকাশ করে, যে তার বিপদেই আনন্দ পায়। (ইবনুল জাওজি, আল-মুপ্তাজাম ফি তারিখিল উমাম : ৬/৯৪-৯৫)
সুধারণা পোষণের উপদেশ
ওমর বিন আব্দুল আজিজি (রহ.)-এর ছেলে বলেন, আমার আব্বা আমাকে উপদেশ দিয়ে বলতেন, ‘হে বৎস! যখন তুমি কোনো মুসলিমের কোনো কথা শুনবে, তবে সেটা ভালো অর্থে ব্যাখ্যা করার সুযোগ থাকলে কখনোই সেটা খারাপ অর্থে নিয়ো না।’ (আবু নুয়াইম, হিলয়াতুল আওলিয়া : ৫/২৭৮)
পরিস্থিতি মোকাবেলা করার উপদেশ
আব্বাসীয় খলিফা মানসুর স্বীয় পুত্র মাহদিকে উপদেশ দিয়ে বলেন, ‘হে আমার বৎস! সে ব্যক্তি প্রকৃত বুদ্ধিমান নয়, যে বিপদে পড়ে যাওয়ার পর সেখান থেকে বেরিয়ে আসার পথ খোঁজে; বরং সত্যিকারের বুদ্ধিমান ওই ব্যক্তি, যে বিপদ আসার আগেই কৌশল অবলম্বন করে, যাতে সে ওই বিপদে না পড়ে।’ (ইবনু কাসির, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ : ১০/১৩৪)
আল্লাহর জিকিরের উপদেশ
ইমাম ইবনুল জাওজি (রহ.) তাঁর পুত্রকে একটি উপদেশমূলক চিঠি লিখেন, সেখানে তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর এই হাদিস উল্লেখ করেন, যে ব্যক্তি বলবে ‘সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি’ তার জন্য জান্নাতে একটি খেজুরগাছ রোপণ করা হবে। অতঃপর বলেন, ‘দেখো বৎস! যে ব্যক্তিজীবনের সময়গুলোকে অবহেলায় নষ্ট করে দেয়, সে জান্নাতের কত গাছ রোপণের সুযোগ হারাচ্ছে!’ (ফাতাওয়া আশ-শাবাকা আল-ইসলামিইয়াহ : ৬/৫৩৪)
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন