বর্তমানে দুনিয়ায় প্রচলিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ইসলাম কতটুকু সমর্থন করে, এ নিয়ে বিতর্ক আছে। বিশেষ করে উপমহাদেশের আলেমদের বড় একটি অংশ প্রচলিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে হারাম মনে করে। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আলেমদের অংশগ্রহণের ভিত্তি কী হবে বা ইসলামের কণ্ঠস্বরকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পৌঁছাতে গেলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় থেকে কোনো রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচনের রূপরেখা কী হবে, এ ব্যাপারে ভারসাম্যপূর্ণ মন্তব্য করেছেন পাকিস্তানের বিখ্যাত দাঈ মুফতি তারেক মাসুদ।
এ ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘দেখুন, ইসলামের যে খাঁটি বা আদর্শ শাসনব্যবস্থা, সেটা হলো, সব মানুষ মিলে এমন একজন ব্যক্তিকে নির্বাচন করবে, যার কাছে দ্বীনের জ্ঞানও আছে, দুনিয়ার জ্ঞানও আছে, আল্লাহভীতি রয়েছে; এবং যে জনগণের হিতাকাঙ্ক্ষী হয়, অভিজ্ঞতাও থাকে, যেমন সাহাবায়ে কেরাম একত্রে পরামর্শ করে আবু বকর (রা.)-কে নির্বাচন করেছিলেন। এটাই হচ্ছে সর্বোত্তম পদ্ধতি।
কিন্তু ইসলাম বলে, যদি এই সর্বোত্তম পদ্ধতিতে শাসক নির্বাচন করা তোমাদের জন্য অসম্ভব হয়, তাহলে যে পদ্ধতি যুগের জন্য উপযোগী এবং যেটার ক্ষতিকর দিক কম হবে, সেই পদ্ধতিই গ্রহণ করে নেওয়া উচিত।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে কখনো কখনো গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ভালো হয়, আবার কখনো কখনো আমিরিয়্যাত ভালো হয়। কিছু দেশ আছে, যেখানে একজন ব্যক্তি জোর করে ক্ষমতা দখল করেছে, কিন্তু ওই ব্যক্তি ন্যায়ের শাসন দিতে পেরেছে, আইন-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে, যদিও সে অগণতান্ত্রিক বা অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতায় এসেছে।
তার ক্ষমতা গ্রহণের পদ্ধতি সঠিক নয়, কিন্তু ক্ষমতাসীন হয়ে সে সেই দেশের জন্য ভালো কাজ করেছে। আবার কিছু ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় এসেও কোনো শাসক দেশের জন্য ভালো করেছে, এ রকম উদাহরণও আছে। যেমন—তুরস্কে এরদোয়ান নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু ক্ষমতাসীন হয়ে সে দেশ ও ইসলামের জন্য ভালো করেছে।
অনেকে বলে, গণতন্ত্র কুফরি, গণতন্ত্র হারাম; তাহলে বিকল্প কী? তারা বলে, খেলাফত আসবে। কিন্তু সেই খলিফা কে হবে? কে নিয়ে আসবে তাঁকে? কিভাবে তিনি ক্ষমতাসীন হবেন? যুদ্ধ হবে, রক্তপাত হবে, খুনখারাবি হবে। তারপর দেখা যাবে, খেলাফত আসার বদলে দেশ পরাধীন হয়ে যাবে, পুরো দেশই ধ্বংস হয়ে যাবে। হ্যাঁ, শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ এক আলাদা বিষয়। আমি বলছি সশস্ত্র পন্থার কথা।
কিন্তু জনগণের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ তো জরুরি। যখন আপনি মনে করেন শাসক অন্যায় করছে, তখন জনগণের প্রতিবাদ করা উচিত। আপনারা যেমন এখানে করেছেন। আপনারা আন্দোলন করেছেন, পরিবর্তন এনেছেন বলেই আমি আসতে পেরেছি। এই আন্দোলনের কারণে বাংলাদেশে এখন আলেমদের জন্য ভিসা সহজ হয়েছে। আগে তো আমরা ভিসাই পেতাম না। বাংলাদেশে আসা কঠিন ছিল। তো, যা বলছিলাম, ইসলাম কোনো নির্দিষ্ট শাসনব্যবস্থাকে বাধ্যতামূলক করে না। যে পদ্ধতি সময়ের বাস্তবতায় উপযুক্ত ও কার্যকর, সেটাই গ্রহণ করতে বলে। হাওয়াই কথা বলবেন না। হাওয়াই স্বপ্ন দেখবেন না। বাস্তবতা দেখুন। যে পদ্ধতি বাস্তবসম্মত ও কার্যকর, সেটা গ্রহণ করুন। গণতন্ত্র কুফরি নয়, আমিরিয়্যাত বা রাজতন্ত্রও কুফরি নয়। কিছু দেশে গণতন্ত্র উপকারী, কিছু দেশে আমিরিয়্যাত।
আপনার নিজের দেশের জন্য কোনটা কল্যাণকর, আপনারা ভালো জানেন। সাধারণভাবে আজকের যুগে গণতন্ত্রই বেশি কার্যকর। কারণ খলিফাদের ওই যুগ তো নেই। আপনি ভাবছেন খেলাফত আসবে, কিন্তু সেই খেলাফতের নামে কোনো এক স্বৈরাচারী এসে আপনার দেশটাকেই ধ্বংস করে ফেলবে। গণতন্ত্রে অন্তত জনগণের কাছে যেতে হয়, জবাবদিহি করতে হয়। আপনি প্রতিবাদ করতে পারেন, রাস্তায় নামতে পারেন, সংসদে আওয়াজ তুলতে পারেন। স্বৈরতন্ত্রে তো এসব কিছুই সম্ভব হবে না।