পৃথিবীর সব মানুষ সফলতা চায়। এ সফলতা একেকজন একেক দৃষ্টিকোণ থেকে নির্ধারণ করে। কেউ দুনিয়ার সম্পদ, নারী, গাড়ি, বাড়ি, ক্ষমতা, প্রভাব-প্রতিপত্তি ইত্যাদির মাধ্যমে নির্ধারণ করে। কেউ আবার সুস্বাস্থ্যকে সফলতার উৎস মনে করে।
কেউ আবার অন্য কিছুকে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মানুষের সফলতা হলো— পরকালে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়ে জান্নাত লাভ করতে পারা আর দুনিয়াতে জান্নাতের যোগ্য হয়ে নিজেকে প্রস্তুত করা। কারণ জান্নাতের অতি সামান্য অংশও দুনিয়া এবং তাতে যা আছে তার চেয়ে উত্তম। আল্লাহ চাইলে এ সফলতার জন্য পৃথিবীতে আল্লাহ তাআলার নির্দেশিত পথ অবলম্বন করেও ধনী, সুখী ও সৌভাগ্যের নিদর্শন লাভ করা সম্ভব।
যেভাবে ধনী হওয়া যায় : প্রায় প্রত্যেক মানুষই ধনী হতে চায়। কিন্তু সম্পদ দিয়ে কি কখনো ধনী হওয়া যায়? কখনোই সম্ভব নয়। কারণ সম্পদের চেয়ে চাহিদা আরো অনেক বেশি। মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার শেষ নেই।
কোনো মানুষের জন্য যদি একটি পাহাড়কে স্বর্ণ বানিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে সে আরেকটি স্বর্ণের পাহাড়ের আকাঙ্ক্ষা করে। এটিই মানুষের স্বভাব। মৃত্যু ছাড়া কোনো কিছুই মানুষের চাহিদা মেটাতে পারে না। চাহিদা না মিটলে ধনী হবে কীভাবে? এ জন্যই নবিজি (সা.) অর্থ-সম্পদ নয়, বরং মনের দিক থেকে ধনী হওয়াকেই ধনী বলেছেন। আল্লাহ তাআলার প্রতি ইমান, তাওয়াক্কুল ও তাকদিরে বিশ্বাস মানুষকে প্রকৃতপক্ষে ধনী অন্তঃকরণ দান করে।
যার ফলে সে গরিব হয়েও দান করতে ভয় করে না। সুতরাং বোঝা যায়, বান্দা অল্পে তুষ্ট থাকলে আল্লাহ তার হৃদয় ধনী ও অভাবমুক্ত করে দেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবি (সা.) বলেন, ‘ধন-সম্পদের আধিক্য হলেই ধনী হয় না, বরং অন্তরের ধনীই প্রকৃত ধনী।’ (বুখারি, হাদিস : ৬৪৪৬, মুসলিম,
হাদিস : ১০৫১, মুসনাদে আহমাদ,
হাদিস: ৭৩২০)
এক দিন রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবি আবু জর (রা.)-কে বললেন, আবু জর! তুমি কি সম্পদের প্রাচুর্যকেই সচ্ছলতা মনে করো? আবু জর (রা.) বলেন, হ্যাঁ, হে আল্লাহর রাসুল। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তাহলে তুমি সম্পদের স্বল্পতাকে দারিদ্র্য মনে করো? তিনি বলেন, হ্যাঁ, আল্লাহর রাসুল। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘আসলে সচ্ছলতা তো হৃদয়ের সচ্ছলতাই, আর হৃদয়ের দারিদ্র্যই হলো আসল দারিদ্র্য।’
(ইবনে হিব্বান, হাদিস : ৬৮৫)
যেভাবে সুখী হওয়া যায় : পৃথিবীতে সবাই সম্পদশালী হয়ে সুখী হতে চায়। সবাই মনে করে, সুখ-শান্তির একমাত্র উৎস ধন-সম্পদ। আসলে কি তাই? মোটেও নয়। ধন আর সুখের মধ্যে সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। তবে জীবিকা নির্বাহ করার মতো প্রয়োজনমাফিক সম্পদের প্রয়োজন রয়েছে। সম্পদের আধিক্য প্রায়ই সুখের পরিবর্তে নানা রকম ব্যস্ততা, চিন্তা-পেরেশানি, নিদ্রাহীনতা ইত্যাদি বাড়িয়ে দেয়। ধনী নারীদের বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনাও তুলনামূলক বেশি দেখা যায়। সে ক্ষেত্রে পার্থিব জীবনে সুখ, শান্তি আর সফলতার জন্য ইসলামের নীতি অত্যন্ত স্পষ্ট। তা হলো— আল্লাহর মনোনীত একমাত্র দ্বিন ইসলাম পেয়ে এবং আল্লাহর দেওয়া প্রয়োজনমাফিক রিজিক পেয়ে পুরোপুরি সন্তুষ্ট ও পরিতুষ্ট থাকতে হবে। আবদুল্লাহ বিন আমর ইবনুল আস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি ইসলামের দিকে হেদায়েতপ্রাপ্ত হয়েছে, যাকে প্রয়োজনমাফিক রিজিক দান করা হয়েছে এবং যে তাতেই পরিতুষ্ট থাকে, সে-ই সফলকাম হয়েছে। (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৪১৩৮)
যেভাবে সৌভাগ্যবান হওয়া যায় : পার্থিব জগতে স্বস্তি পেতে চারটি জিনিস দরকার। এসব পেয়ে গেলে এ জগতে সে সৌভাগ্যবান। সেগুলো হলো—(১) পুণ্যবতী স্ত্রী। এটিই সব সম্পদের সেরা সম্পদ। (২) প্রশস্ত তথা বহুবিধ সুবিধাসম্পন্ন বাড়ি। (৩) উত্তম প্রতিবেশী, যারা সুখে-দুঃখে পাশে থাকে। (৪) নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যে চলাচল করার মতো বাহন। এসব কিছু নির্ভর করে সামর্থ্যের ওপর। হালাল ও বৈধ পথে যতটুকু পাওয়া যায়, ততটুকুতে সন্তুষ্ট থাকতে হবে। না পেলে ধৈর্য ধারণ করতে হবে এবং আল্লাহর রহমত কামনা করতে হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) এসবের মধ্যে কেবল প্রথমটি ছাড়া আর কোনো কিছু পাননি। তাঁর অতি সংকীর্ণ ও ছোট ঘর ছিল। তিনি নামাজে দাঁড়ালে আয়েশা (রা.) পা মেলে শুয়ে থাকতে পারতেন না। বিছানায় শোয়া থেকে উঠলে তাঁর শরীরে চাটাইয়ের দাগ দেখা যেত। তিনি প্রতিবেশীর জ্বালাতনে মক্কা ছেড়ে মদিনায় হিজরত করেছেন। সেখানেও তাঁকে নানা চক্রান্তের মোকাবেলা করতে হয়েছে। আর তাঁর বাহন ছিল গাধা, যা সে সময়ের সবচেয়ে নিচুমানের বাহন হিসেবে পরিগণিত হতো। তিনি এসবেই সন্তুষ্ট থেকেছেন। এককথায় পার্থিব জীবনে হালাল উপায়ে এসব পেয়ে গেলে এবং আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও হালাল পথে এসবের ব্যবহার হলে নিঃসন্দেহে তা সৌভাগ্যের লক্ষণ। সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘চার বস্তু সৌভাগ্যের নিদর্শন : পুণ্যবতী স্ত্রী, প্রশস্ত বাড়ি, সৎ প্রতিবেশী ও আরামদায়ক বাহন। আর চার বস্তু দুর্ভাগ্যের নিদর্শন : মন্দ স্ত্রী, সংকীর্ণ বাড়ি, মন্দ প্রতিবেশী ও মন্দ বাহন।’ (মুসনাদ আহমাদ, হাদিস : ২৪৪৫; সহিহ ইবনে হিব্বান,
হাদিস : ৪০৩২)
পরিশেষে একটি আয়াতের কথা স্মরণ করা যায়—‘অতঃপর যাকেই জাহান্নাম থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হবে, সে-ই প্রকৃত অর্থে সফলকাম হবে। আর (জান্নাতের বিপরীতে) পার্থিব জীবন তো প্রতারণার উপকরণ ছাড়া কিছুই নয়।’
(সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৮৫)
কাজেই পার্থিব জীবন পেয়ে প্রতারিত না হয়ে, বরং তাকে জান্নাতের উপকরণ বানানোর পথ অবলম্বন করতে পারলেই দুনিয়ার জীবনে ধনী, সুখী ও সৌভাগ্যবান হওয়া সম্ভব।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
বিডি প্রতিদিন/কেএ