মঙ্গলবার, ২৭ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

বাণিজ্যের নতুন দ্বার উজবেকিস্তান

শাহ্ দিদার আলম নবেল, উজবেকিস্তান থেকে ফিরে

বাণিজ্যের নতুন দ্বার উজবেকিস্তান

মধ্য এশিয়ার দেশ উজবেকিস্তান। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে দেশটি। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে উজবেকিস্তানকে স্বীকৃতিদানকারী প্রথমসারির দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ একটি। শুরু থেকে দুই দেশের মধ্যে চমৎকার কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকলেও নানা প্রতিকূলতায় সে অনুযায়ী প্রসার ঘটেনি ব্যবসা-বাণিজ্যের। তবে গত ১৬ জুলাই ‘মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়া : আঞ্চলিক সংযুক্তি, সংকট ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক সম্মেলন শেষে উজবেকিস্তানের রাষ্ট্রপতি সাভকাত মিরজিয়য়েভের সঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে দুই দেশের মধ্যকার ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। বৈঠকে দুই দেশের কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও জোরদারে উজবেকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ঢাকায় দূতাবাস স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়ার নির্দেশ দেন। আশ্বস্ত করেন ঢাকার সঙ্গে তাশখন্দের সরাসরি ফ্লাইট চালুর। ফলে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে উজবেকিস্তানে নতুন নতুন পণ্য আমদানি-রপ্তানি ও যৌথ উদ্যোগে শিল্পকারখানা স্থাপনের।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে উজবেকিস্তানে যেসব পণ্য রপ্তানি হয়ে থাকে তার মধ্যে রয়েছে- পাট ও পাটজাতপণ্য, তামাক ও তামাকজাতপণ্য, ওষুধ, সুতা ও সুতা দিয়ে তৈরি জিনিসপত্র, নিটেড ফেব্রিকস, রেডিমেড গার্মেন্টস সামগ্রী ও টেক্সটাইল ফেব্রিক্স। আর আমদানি পণ্যের মধ্যে রয়েছে- সুতা, নানা জাতের ফল ও সবজি, কৃষিপণ্য এবং জীবিত প্রাণী।

এ ছাড়া বাংলাদেশ থেকে আরও বেশি পরিমাণে ওষুধসামগ্রী, পাট ও পাটজাত পণ্য, চা, চিংড়ি, মৌসুমি ফল, সিরামিক, শুঁটকি ও মেলামাইনসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য উজবেকিস্তানে রপ্তানির সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (ইস্ট ইউরোপ ও সিআইএস) সিকদার বদিরুজ্জামান। এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নানা উদ্যোগ নিয়েছে বলেও জানান তিনি।

এদিকে, বাণিজ্য সম্প্রসারণের লক্ষ্যে কয়েক বছর ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এ লক্ষ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও উজবেকিস্তানে বাংলাদেশ দূতাবাস কাজ করে যাচ্ছে। উজবেকিস্তানে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. জাহাঙ্গীর আলম জানান, বাণিজ্য সম্প্রসারণের লক্ষ্যে উজবেকিস্তানে দুই দেশের যৌথ মালিকানায় একটি জুস ফ্যাক্টরি স্থাপনে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা চলছে। এ ব্যাপারে উজবেকিস্তানও আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে উজবেকিস্তানে জেনারেল মোটর ও গাড়ি অ্যাসেম্বলিং কারখানা

স্থাপনের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে সে দেশের সরকার। যৌথ উদ্যোগে স্থাপিত এসব কারখানায় উৎপাদিত পণ্য পরে আমদানি করবে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্র জানায়, চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি উজবেকিস্তানের ফারগানা প্রদেশের গভর্নরের সঙ্গে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. জাহাঙ্গীর আলমের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে গভর্নর বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের জন্য শিল্পকারখানা স্থাপনে বিনামূল্যে ভূমি সুবিধা এবং ৫০ শতাংশ ব্যাংকিং সুবিধা প্রদানের লিখিত প্রতিশ্রুতি দেন। এতে উজবেকিস্তানের ফারগানা অঞ্চলে বাংলাদেশি বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

গত ১৫ ও ১৬ জুলাই উজবেকিস্তানের তাশখন্দে অনুষ্ঠিত হয় ‘মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়া : আঞ্চলিক সংযুক্তি, সংকট ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক সম্মেলন। ওই সম্মেলনের পর উজবেকিস্তানের রাষ্ট্রপতি সাভকাত মিরজিয়য়েভের সঙ্গে বৈঠক করেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন। বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ঢাকায় উজবেকিস্তানের দূতাবাস স্থাপন ও সরাসরি ফ্লাইট চালুর অনুরোধ জানান মোমেন। বৈঠক থেকে রাষ্ট্রপতি সাভকাত ঢাকায় কনস্যুলেট স্থাপনে তার দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে নির্দেশ দেন। ঢাকার সঙ্গে তাশখন্দের সরাসরি ফ্লাইটের খসড়া চূড়ান্ত হয়।

এ ছাড়া চলতি বছরের আগস্টের শেষের দিকে ‘প্রথম ফরেন অফিস কনস্যুলেশন (এফওসি) মিটিং’ ও সেপ্টেম্বরে ‘তৃতীয় জয়েন্ট ট্রেড কমিশন মিটিং’ আয়োজনের ব্যাপারে দুই দেশ সম্মত হয়। এ ছাড়া ২০২২ সালের প্রথমদিকে উজবেকিস্তানের রাষ্ট্রপতি সাভকাত মিরজিয়য়েভের প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সফরের সিদ্ধান্ত হয়। এ ছাড়া উজবেকিস্তানের পরিবহনমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন। ওই বৈঠকেও দুই দেশের মধ্যে সরাসরি ফ্লাইট চালু, শিল্প, পর্যটন, শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদারে গুরুত্বারোপ করা হয়।

উজবেকিস্তানে বাংলাদেশ দূতাবাস জানায়, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নে পর্যটন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। বাংলাদেশ থেকে অনেক পর্যটক উজবেকিস্তান বেড়াতে যান। পাশাপাশি উজবেকিস্তানের জনগণেরও বাংলাদেশের দর্শনীয় স্থান ভ্রমণে আগ্রহ রয়েছে। সরাসরি ফ্লাইট চালু হলে এবং ঢাকায় উজবেকিস্তানের কনস্যুলেট অফিস স্থাপন হলে পর্যটন শিল্প দুই দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। এ ছাড়া, বাংলাদেশের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং উজবেকিস্তানের সমরখন্দ সিল্ক রোড বিশবিদ্যালয়ের মধ্যে শিক্ষা ও পর্যটন বিনিময়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে।

গত বছরের নভেম্বর থেকে উজবেকিস্তানে শুরু হয়েছে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রপ্তানি। গত বছরের নভেম্বরে বাংলাদেশ থেকে ৮৮৮ জন কর্মী উজবেকিস্তান যান। আরও জনশক্তি রপ্তানির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। এ লক্ষ্যে গত বছরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জাহাঙ্গীর আলম এবং উজবেকিস্তানের শ্রম ও কর্মসংস্থানবিষয়ক মন্ত্রী নজিব কুশানভ বকতিরিওভিচের মধ্যকার বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে দক্ষ শ্রমিক বিনিময়ের ব্যাপারে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। রাষ্ট্রদূত উজবেকিস্তানের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গেও বৈঠক করেন। বৈঠকে যৌথ উদ্যোগে টেক্সটাইল, ফার্মাসিউটিক্যালস স্থাপন নিয়ে আলোচনা হয়। উপ-পরাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ থেকে টেক্সটাইল খাতে বিশেষজ্ঞ পাঠানোর অনুরোধ জানান।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন জানান, উজবেকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের চমৎকার কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। ঢাকায় দূতাবাস স্থাপন ও সরাসরি ফ্লাইট চালু হলে দুই দেশের সম্পর্কের আরও ব্যপ্তি ঘটবে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও পযর্টনশিল্পে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ ব্যাপারে উজবেকিস্তানের সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনাও হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর