বৃহস্পতিবার, ৬ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

শব্দদূষণে কান পাতা দায়

♦ আতশবাজি-পটকার শব্দে নতুন করে উদ্বেগ ♦ কয়েক বছর ধরে ৩১ ডিসেম্বর রাতেই শব্দমান পৌঁছায় ১১০ ডেসিবেলে ♦ সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় উৎসবগুলো থেকে হচ্ছে শব্দদূষণ

জিন্নাতুন নূর

শব্দদূষণে কান পাতা দায়

জন্মগতভাবেই হৃদযন্ত্রে ছিদ্র ছিল চার মাস বয়সী শিশু উমায়েরের। রাজধানীর মিরপুরের ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালে নিয়মিত চিকিৎসা নিচ্ছিল শিশুটি। শনিবার বছরের প্রথম দিন শ্বাসকষ্টে ভোগা শিশুটিকে নিয়ে তার বাবা ইউসুফ রায়হান আসেন হাসপাতালে। কিন্তু হাসপাতালে ভর্তির ৩ ঘণ্টা পর হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে শিশুটি মারা যায়। ইউসুফ রায়হান জানান, বর্ষবরণের রাতে আতশবাজির বিকট শব্দে ভয়ে বারবার কেঁপে উঠছিল উমায়ের। সারারাত শিশুটি ঘুমাতে পারেনি। সকালে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শিশুটি মারা যায়।

শিশু উমায়েরের মতোই ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর সন্ধ্যার পর থেকে ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় ঘন ঘন আতশবাজি এবং পটকার তীব্র শব্দে কষ্ট পেতে হয় আরও অনেক শিশুকে। সেদিন রাত ১২টার পর থেকে লাগাতার আতশবাজি ও পটকার উচ্চ শব্দে কান পাতা কষ্টকর হয়ে পড়ে। বিশেষ করে বয়স্ক ও শিশুসহ রোগীরা আতঙ্কের একটি রাত পার করেন। বর্ষবরণ ছাড়াও এখন কারও গায়ে হলুদ, বিয়ে এবং জন্মদিনের অনুষ্ঠানেও আতশবাজি ও পটকা পোড়ানো হচ্ছে। এতে করেও নগরীতে তৈরি হচ্ছে তীব্র শব্দদূষণ।

ঢাকার প্রধান সড়কগুলো হচ্ছে শব্দদূষণের আরেক উৎপত্তিস্থল। সড়কে নামলেই প্রাইভেট কার থেকে শুরু করে বাস, পিকাপ ভ্যান এবং মোটরসাইকেল চালকরা আগে যাওয়ার জন্য প্রতিযোগিতায় নামেন। এ জন্য অপ্রয়োজনে ঘন ঘন গাড়ির হর্ন বাজান। এ থেকেও শব্দদূষণ ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। নগরজুড়ে চলমান মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এবং উড়ালসড়কসহ  বড় বড় ভবন নির্মাণের জন্যেও উচ্চমাত্রার শব্দদূষণ তৈরি হচ্ছে। আবাসিক এলাকাগুলোতে নিয়ম না মেনে গভীর রাতেও ভবন নির্মাণকাজ চলছে। এতে আশপাশে শব্দদূষণ ঘটছে। স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) এক সমীক্ষা বলছে, শব্দদূষণ নীতিমালা ২০০৬ অনুযায়ী নীরব এলাকা হিসেবে সচিবালয় এলাকায় দিনে শব্দের মাত্রা ৫০ ডেসিবেল থাকার কথা। কিন্তু গবেষণায় দেখা যায়, সচিবালয়ের পশ্চিমে মসজিদের পাশের এলাকা ছাড়া সব জায়গায় ৭০ ভাগের বেশি সময় ধরে শব্দের মাত্রা ছিল ৭০ ডেসিবেলের (তীব্রতর) বেশি। আর সামগ্রিকভাবে উপাত্ত নেওয়া ১২টি স্থানে সস্মিলিতভাবে ৯১ দশমিক ৯৯ ভাগ সময় ৭০ ডেসিবেলের (তীব্রতর) বেশি মাত্রার শব্দ হয়েছিল। এ ছাড়া সর্বোচ্চ সময় ধরে তিনটি স্থান- পল্টন বাসস্ট্যান্ড (১০০ ভাগ সময়), জিরো পয়েন্ট (৯৯ দশমিক ৪ ভাগ সময়) এবং কদম ফোয়ারাতে (৯৯ দশমিক ২ ভাগ সময়) নিয়মিতভাবে শব্দের মাত্রা ৭০ ডেসিবেলের বেশি ছিল। এর বাইরেও ঢাকার আরও ৭০টি এলাকায় ক্যাপস-এর গবেষণা দল শব্দদূষণ জরিপ চালায়। সেখানেও শব্দের মাত্রা গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি ছিল।

নাক, কান ও গলা রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শব্দদূষণ শুধু কানের ক্ষতিই করে না। এটি মানসিক ও শারীরিক ক্ষতিও করে। অতিরিক্ত শব্দের জন্য কানের শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বিকট শব্দের জন্য কানের পর্দাও ফেটে যেতে পারে। এমনকি অন্তঃকর্ণেও অনেক সময় রক্তক্ষরণ হতে পারে। রাতে নির্মাণকাজের জন্য সৃষ্ট শব্দদূষণেও মানুুষ ঘুমাতে পারে না। আর রাতে পর্যাপ্ত ঘুম না হলে মানুষ দিনে সুস্থভাবে কাজ করতে পারবে না। এতে ঝিমুনি থাকবে, কাজে মনোযোগ কমে যাবে। ক্যাপস কয়েক বছর ধরে ৩০ ডিসেম্বর রাতের সঙ্গে ৩১ ডিসেম্বর রাতের শব্দমান তুলনা করে দেখছে। এতে দেখা যায়, ৩০ ডিসেম্বর রাত ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত যেখানে শব্দমান ৩০ ডেসিবেল পর্যন্ত পাওয়া যায় সেখানে ৩১ ডিসেম্বর একই সময় পাওয়া যায় ১১০ ডেসিবেল পর্যন্ত, যা একজন মানুষকে বধির করে দেওয়ার শক্তি রাখে। বিশেষজ্ঞরা জানান, শব্দদূষণের জন্য পরিবেশ অধিদফতরের তিন বছর মেয়াদি প্রায় ৪৭ কোটি টাকার প্রকল্প আছে। এর মাধ্যমে শব্দের দূষণ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরির কথা থাকলেও কার্যত তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না। সে অর্থে এ ধরনের প্রকল্পের সুফলও মানুষ ভোগ করতে পারছে না। বিশেষ করে দিনভিত্তিক উদযাপনের আগে যদি গণমাধ্যমে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো যায় তাহলে কিছুটা হলেও আতশবাজি পোড়ানো যে আইনবহির্ভূত কাজ তা মানুষ জানতে পারত। ক্যাপসের প্রধান ও বায়ুমান বিজ্ঞানী ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শব্দদূষণকে নীরব ঘাতক না বলে একে সরব ঘাতক বলা উচিত। পরিবেশ অধিদফতরের এক জরিপ অনুযায়ী ঢাকায় পরিবহন থেকে সবচেয়ে বেশি শব্দদূষণ হচ্ছে। আমরা ঢাকায় প্রতি বছর ৭০টি স্থানে শব্দের মান পরিমাপ করে থাকি। এসব স্থানে দিনে ও রাতে কোথাও নির্ধারিত মানমাত্রা পাওয়া যায় না। বাণিজ্যিক ও আবাসিক এলাকাগুলোতেও নির্ধারিত মানমাত্রার প্রায় দ্বিগুণ শব্দ পাওয়া যায়। যানবাহন ছাড়াও নির্মাণ প্রকল্প, গৃহস্থালির দৈনন্দিন কাজ থেকে শব্দদূষণ হচ্ছে। আর বর্তমানে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় উৎসবগুলো থেকে অত্যধিক শব্দদূষণের সৃষ্টি হচ্ছে। এর সঙ্গে বর্ষ উদযাপনও শব্দদূষণের মাত্রা বৃদ্ধি করছে। সাকরাইন, শবেবরাত, অন্যান্য ধর্মীয় উৎসবে বাজি ও আতশবাজি পোড়ানো হচ্ছে। বিশেষ করে ৩১ ডিসেম্বরে বর্ষবরণ উদযাপনে শব্দের দূষণ বেশি হয়। গত কয়েক বছরে বছরের শেষ দিনে এসব ব্যবহারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে নিষেধাজ্ঞা জারি করা সত্ত্বেও মানুষ এগুলো পোড়াচ্ছে। আমরা বিশেষ দিবসে আতশবাজি ও পটকা পোড়ানো বন্ধের জন্য একটি রিট করতে যাচ্ছি। শব্দদূষণ বিধিমালা অনুযায়ী আবাসিক এলাকায় রাত ৯টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত শব্দের মাত্রা ৪৫ ডেসিবেল এবং দিনের অন্য সময়ে ৫৫ ডেসিবেল অতিক্রম করার কথা না। আবার বাণিজ্যিক এলাকায় তা যথাক্রমে ৬০ ও ৭০ ডেসিবেল থাকার কথা। হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং অফিস-আদালতের আশপাশে ১০০ মিটার পর্যন্ত নীরব এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে রাতে ৪০ ও দিনে ৫০ ডেসিবেল পর্যন্ত শব্দের মাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এই শব্দ মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে না।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর