বুধবার, ১৮ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

নকল মদে বাজার সয়লাব

আলী আজম

নকল মদে বাজার সয়লাব
অবৈধভাবে মদ উৎপাদনকারীরা ইথানলের সঙ্গে মিথানলের মিশ্রণ করে এক বোতল মদকে ১০ বা ২০ বোতল মদ তৈরি করছে। এই মদ খেলে অন্ধ হয়ে যাওয়া, কিডনি বিকল করে দেওয়া ও হার্টঅ্যাটাকে মৃত্যুর ঘটনা ঘটতে পারে।

ভেজাল বা নকল মদ খেয়ে বিষক্রিয়ায় মৃত্যু, অঙ্গহানি বা অসুস্থ হওয়ার খবর মাঝেমধ্যেই শোনা যায়। ভেজাল মদ্যপানের পর বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হতাহতের ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। এতে করে উদ্বেগ বাড়ছে। বিভিন্ন সংস্থার কড়াকড়ি আরোপ থাকায় বিদেশি মদের সরবরাহ কমেছে। এই সুযোগে সক্রিয় হয়ে উঠেছে একটি নকল মদ বিক্রেতা চক্র। ওয়্যার হাউসগুলো থেকে মদ বিক্রিতে কড়াকড়ি থাকায় বাজারে মদের সংকট তৈরি হয়েছে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে চক্রটি ভেজাল মদ তৈরির কারখানা গড়ে তোলে। এই মদ তারা খুচরা ও পাইকারি বাজারে বিক্রি করছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় লাইসেন্সধারী মদের বারগুলোয় বিদেশি মদ বিক্রিতে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। এতে হঠাৎ করেই বাজার থেকে বিদেশি মদ উধাও হয়ে গেছে। কৃত্রিম এই সংকট সৃষ্টির কারণে সাধারণ মানের মদের দাম বেড়েছে। এ পরিস্থিতিতে বিদেশি বিভিন্ন নামিদামি ব্র্যান্ডের বোতলে মাত্রাতিরিক্ত অ্যালকোহল, স্পিরিটের পাশাপাশি নেশাজাতীয় অন্যান্য পদার্থ মেশানো নকল মদে বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। ভেজাল মদ প্রস্তুতকারীরা ভালোমন্দের কথা বিবেচনা না করে শুধু বাড়তি লাভের আশায় এ ধরনের বিষাক্ত মদ দেদার বিক্রি করছে।

বাজারে ভেজাল মদের ছড়াছড়ির বিষয়টি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের (ডিএনসি) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও নিঃসংকোচে স্বীকার করেছেন। তারা জানান, একাধিক অভিযানে বিপুল ভেজাল মদ ধরা পড়ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, দেশের ভিতরে ও সীমান্ত দিয়ে মদ আসছে। ছোটবড় চালান ধরা পড়ছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বেশ কয়েকটি নকল মদের কারখানার সন্ধান মিলেছে। ওইসব কারখানায় পানি, রেকটিফাইড স্পিরিট, ইথানল, মিথানলসহ উচ্চ তাপমাত্রার অ্যালকোহল, রং ও ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে বিষাক্ত মদ তৈরি করা হতো।

এ ছাড়া দেশীয় চোলাই মদের সঙ্গে অতিমাত্রায় অ্যালকোহল মিশিয়েও তৈরি হচ্ছে তীব্রতাযুক্ত শক্তিশালী মাদক। যা পান করে ডাকসাইটে মাদকসেবীরাও জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে মৃত্যুর কোলেও ঢলে পড়েন। আবার ড্রিংকসের সঙ্গেও অ্যালকোহল ও অতিমাত্রায় রেকটিফাইড স্পিরিট মিশিয়ে বিভিন্ন নামের অ্যানার্জি ড্রিংক বাজারজাত চলছে অবাধে। চিকিৎসকরা জানান, এসব ভেজাল মদ তৈরির সঙ্গে জড়িতদের এ ব্যাপারে কোনো জ্ঞান না থাকায় অনেক সময় তারা মাত্রাতিরিক্ত স্পিরিট ও ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিচ্ছেন। ফলে তা পান করে অনেক সময় হতাহতের ঘটনা ঘটছে।

কয়েকজন সেবনকারী জানান, বৈধভাবে দেশে মদ আমদানি বন্ধ রয়েছে। কেমল বিদেশিদের ক্ষেত্রে কিছু মদ আমদানি করা হচ্ছে। স্থানীয় ব্যবসায়ী ও বারগুলোয় বিদেশি মদ পাওয়া যাচ্ছে না। এক সময় স্থানীয় ব্যবসায়ীরা নিজেরাই সরাসরি আমদানি করতেন। ডলার সংকটের কারণে এই আমদানি এখন বন্ধ রয়েছে। দেশে উৎপাদিত কেরু অ্যান্ড কোং মদের দেশের কোথাও বিক্রয় কেন্দ্র নেই। ঢাকা বা বড় শহরগুলোয় সীমিত কয়েকটি কেন্দ্র থাকলেও সেখানে সবাই কিনতে পারেন না। এই সুযোগে ভেজাল মদ বিক্রেতারা কারখানা খুলে বসেছেন। তারা ভেজাল মদ পাইকারি ও খুচরা বিক্রি করছেন।

বিদেশি মদ অনেকটা দুর্লভ হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান সব ধরনের মদ এবং আরেকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিয়ার তৈরি করে থাকে। কিন্তু দেশীয় এসব পণ্যের বাইরে বিদেশি মদেরও বিপুল চাহিদা রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকার একজন নিয়মিত মদপানকারী বলেছেন, আগে বিভিন্ন বার, ওয়্যারহাউস থেকে সহজেই মদের বোতল কেনা যেত। কিন্তু এখন বেশি টাকা দিয়েও সেখান থেকে মদ কেনা যায় না। তাই আমরা অনেকেই পরিচিত সরবরাহকারীর কাছ থেকে মদ সংগ্রহ করে থাকি। তবে সেটা আসল না ভেজাল তা বোঝার উপায় নেই।

কয়েকটি বারের কর্মকর্তারা জানান, আগে বিভিন্ন ওয়্যারহাউস বা ক্লাব থেকে অনেকে মদ কিনতেন। বর্তমানে বিদেশি নাগরিক ছাড়া মদ বিক্রি একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে যারা বিদেশি মদপানে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন, তারা এখন বিভিন্ন সূত্র থেকে মদ কেনার চেষ্টা করছেন। মূলত এই সুযোগকেই কাজে লাগাচ্ছেন ভেজাল কারবারিরা। দেশে উৎপাদিত মদ অনেকে পছন্দ করেন না। যারা বিভিন্ন মাধ্যমে মদ কিনছেন তারা মূলত বিদেশি বোতলে ভেজাল মদ কিনছেন, প্রতারিত হচ্ছেন।

ডিএনসির প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক ডা. দুলাল কৃষ্ণ লাল বলেন, যারা বিদেশি মদের নামে নকল মদ তৈরি করছেন, তারা যথাযথভাবে রাসায়নিক মিশ্রণ করছেন না। মিথানল ও ইথানল দেখতে অনেকটা একই রকম। ইথানল খাওয়ার যোগ্য। কিন্তু মিথানল খাওয়ার অযোগ্য এবং দামে অনেক কম। ভেজাল মদে মিথানল ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে সেটি বিষাক্ত হয়ে উঠছে, যা অনেক সময় মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠছে।

রং, ফ্লেভার মিশিয়ে বিদেশি বোতলে ভেজাল মদ ভর্তি করা হচ্ছে। বিদেশি মদ বলে বিক্রি করা হচ্ছে। অনেকে এসব মদ খেয়ে মারা যাচ্ছেন। কেউ কেউ জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। আইনি প্রক্রিয়ায় মদ আনতে গেলে ৩০০ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়। ব্যবসায়ীরা এ ক্ষেত্রে অনীহা প্রকাশ করেন। তবে তারা দেশে উৎপাদিত কেরু অ্যান্ড কোং থেকে মদ সংগ্রহ করে বিক্রি করলে সেবনকারীরা উপকৃত হবেন।

ডিএনসি সূত্র জানায়, গত বছরে সারা দেশে ৩০ হাজার ১৮৩ বোতল ফেনসিডিল, ২১৮ লিটার ৯৬ গ্রাম তরল ফেনসিডিল, ১৯৪ লিটার ১০০ গ্রাম দেশি মদ, ৮ হাজার ৯৮৮ লিটার ১৫৭ গ্রাম চোলাই মদ, ৪৩ হাজার ৫৮৫ লিটার জাওয়া, ২ হাজার ৩৩৫ বোতল বিদেশি মদ, ২৮ লিটার ১১৫ গ্রাম বিদেশি মদ, ১ হাজার ৩৯১ ক্যান বিয়াল জব্দ করা হয়েছে। বিজিবি সূত্র জানায়, গত বছর সারা দেশে ৩ লাখ ১৬ হাজার ১৫৭ বোতল ফেনসিডিল, ১ লাখ ৮২ হাজার ৯৩২ বোতল বিদেশি মদ, ৪ হাজার ৬৪ লিটার বাংলা মদ, ৩৭ হাজার ১২৬ ক্যান বিয়ার উদ্ধার করা হয়।

ডিএনসি উপপরিচালক (নিরোধ শিক্ষা, গবেষণা ও প্রকাশনা) মানজুরুল ইসলাম বলেন, যাদের মদ খাওয়ার পারমিট রয়েছে, তাদের সমস্যা হচ্ছে না। যাদের পারমিট নেই, তারা বৈধভাবে মদ না পেয়ে অবৈধভাবে মদ সংগ্রহ করছেন। বারগুলো বছরে যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে তার সাড়ে ১২ শতাংশ টাকার মদ আমদানি করতে পারেন। অবৈধভাবে মদ উৎপাদনকারীরা ইথানলের সঙ্গে মিথানলের মিশ্রণ করে এক বোতল মদকে ১০ বা ২০ বোতল মদ তৈরি করছেন। এই মদ খেলে অন্ধ হয়ে যাওয়া, কিডনি বিকল করে দেওয়া ও হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুর ঘটনা ঘটতে পারে।

ডিএনসির ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের অতিরিক্ত পরিচালক মো. জাফরুল্ল্যাহ কাজল বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান জিরো টলারেন্স। মাদকের বিষয়ে আমরা যখনই কোনো তথ্য পাই তখনই সেখানে অভিযান পরিচালনা করছি। মাদক উদ্ধারসহ আসামিদের গ্রেফতার করছি।

ডিএনসির পরিচালক (অপারেশনস ও গোয়েন্দা) তানভীর মমতাজ জানান, আমরা মাদকের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি। এ ক্ষেত্রে কাউকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। বারগুলো থেকে যেন অবৈধ মদ বিক্রি করা না হয় তা মনিটরিং করা হচ্ছে। মাদকের যে কোনো তথ্য ০১৯০৮৮৮৮৮৮৮ এই নম্বরে জানানোর অনুরোধ করেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর