বৃহস্পতিবার, ৪ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

আইএমএফের হাজারো প্রশ্ন

মানিক মুনতাসির

আইএমএফের হাজারো প্রশ্ন

বাংলাদেশকে শর্তসাপেক্ষে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দিতে চাওয়া ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির আলোচনা শুরু হয়েছে। এ উপলক্ষে ঢাকায় অবস্থান করছে সংস্থাটির একটি প্রতিনিধি দল। একই সময়ে সরকারের মধ্যে চলছে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের প্রস্তুতিও। দ্বিতীয় কিস্তির আলোচনায় সংস্থাটির পক্ষ থেকে বাংলাদেশের চলমান অর্থনীতি ও আর্থিক কাঠামোর সংস্কার বিষয়ে হাজারো প্রশ্ন তোলা হয়েছে। এর মধ্যে ব্যাংক কোম্পানি আইনের খসড়ায় কী রয়েছে তা জানতে চাওয়া হয়েছে। সব ব্যাংকের যাবতীয় আর্থিক বিবরণী, আর্থিক নীতির গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, গত ১০ বছরে ভর্তুকির সব তথ্য, বাজেট বরাদ্দের ফিরিস্তি, রাজস্ব আদায় ও করদাতা বৃদ্ধির সুনির্দিষ্ট, বিশদ পরিকল্পনাসহ আর্থিক খাতের খুঁটিনাটি বিষয়াদি সম্পর্কে জানতে চায় সংস্থাটি। এমনকি বাজেট ও আর্থিক খাতের স্পর্শকাতর বিষয়ের তথ্যও জানতে চায় আইএমএফ। অন্যথায় ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি আটকে যেতে পারে। এদিকে সংস্থাটির দেওয়া শর্তগুলো পরিপালনের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে ও এসব তথ্য পর্যালোচনায় আগামী সেপ্টেম্বরে আসবে আইএমএফের আরেকটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল। অর্থ বিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

ব্যাংক কোম্পানি আইনের খসড়া, সব ব্যাংকের যাবতীয় আর্থিক বিবরণী, আর্থিক নীতির গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, গত ১০ বছরের ভর্তুকির সব তথ্য, বাজেট বরাদ্দের ফিরিস্তি, রাজস্ব আদায় ও করদাতা বৃদ্ধির সুনির্দিষ্ট বিশদ পরিকল্পনাসহ আর্থিক খাতের খুঁটিনাটি বিষয়াদি সম্পর্কে জানতে চায় সংস্থাটি

ঢাকা সফররত আইএমএফ প্রতিনিধি দল একাধিক বৈঠকে ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংশোধনী সম্পর্কে জানতে চেয়েছে। তারা ব্যাংক কোম্পানি আইনের খসড়াও দেখতে চেয়েছে। তার কপিও সংস্থাটির সদর দফতরে পাঠানোর তাগিদ দিয়েছেন তারা। অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে- এখনই সেটা পাবলিক করা যাবে না। পাসের জন্য সংসদে উত্থাপন করা হলে তাদেরও কপি দেওয়া হবে। প্রতিনিধি দলের সামনে দেশের ব্যাংক ব্যবস্থার সার্বিক অবস্থা তুলে ধরে একটি প্রেজেন্টেশন দেওয়া হয়। তাতে বছরভিত্তিক খেলাপি ঋণের চিত্র, ঋণ বিতরণ, আদায়, মূলধন ঘাটতি, সঞ্চয় পরিস্থিতিসহ ব্যাংকগুলোর সার্বিক চিত্র তুলে ধরা হয়। এসব তথ্যের অফিশিয়াল ডকুমেন্ট চেয়েছে আইএমএফ। সরকার ভর্তুকি বরাদ্দের অর্থ কোথায় কোথায় খরচ করছে। কোন খাতে ভর্তুকি প্রয়োজন আছে। কোথায় নেই সে সম্পর্কেও বিস্তারিত তথ্য চায় সংস্থাটি। শুধু তাই নয়, কৃষি ও জ্বালানি খাতের ভর্তুকি কতটুকু যৌক্তিকীকরণ করা হয়েছে। সেটা আসলেও যৌক্তিক কি না-আবার কবে নাগাদ বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়ানো হবে। তার প্রস্তুতি রয়েছে কি না- সে সম্পর্কে তথ্য চাওয়া হয়েছে।

প্রতিনিধি দল ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর, অর্থ বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, বাজেট অনুবিভাগ, পরিকল্পনা কমিশন, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগসহ (ইআরডি) বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সঙ্গে বৈঠক করেছে।

এদিকে বাংলাদেশ কী পরিমাণ বৈদেশিক ঋণ নিয়েছে তার ডাটাবেজও চেয়েছে আইএমএফ। এ ছাড়া ডাটাবেজে কোন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় সেটিও জানতে চেয়েছে সফরে আসা এ প্রতিনিধি দল। এ প্রসঙ্গে ইআরডি সচিব শরিফা খান সাংবাদিকদের বলেন, আইএমএফ আমাদের কাছে ঋণ সংক্রান্ত ডাটাবেজ নিয়ে জানতে চেয়েছে। আমরা তা নিয়েই আলোচনা করেছি।

আইএমএফের এই ঋণের বিপরীতে ছোট-বড় ৩৮টি লিখিত শর্ত পূরণ করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। শর্তগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই আর্থিক খাতের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। আর্থিক খাতের মধ্যে আবার বড় অংশজুড়ে রয়েছে ব্যাংক খাত। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্বে। এর মধ্যে গত মার্চ পর্যন্ত অর্জন এবং আগামী জুন ও সেপ্টেম্বরের মধ্যে যেগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে তার সর্বশেষ পরিস্থিতি যাচাই করছে এবারের মিশন। এর বাইরে আর্থিক খাত ও সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আরও বহু প্রশ্ন তুলেছে এবং তথ্য চেয়েছে সংস্থাটি। এদিকে রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ নিয়েও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে প্রতিনিধি দল। কেননা এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ অব্যাহতভাবে বাড়ছে। খেলাপি ও অবলোপন থেকে আদায়ও তেমন হচ্ছে না। ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো থেকে আমানত সরিয়ে নিচ্ছেন গ্রাহকরা। ব্যাংক তথা আর্থিক খাতের জন্য যে পাঁচ আইন করতে হবে, সেগুলোর একটি মাত্র মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদন পেয়েছে, বাকিগুলোর খসড়া আছে পরীক্ষা-নিরীক্ষার আওতায়। এসব বিষয়েও বিস্তারিত তথ্য চাওয়া হয়েছে। বর্তমানে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। অন্যদিকে কৃষি ও জ্বালানি খাতে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি গুনতে হচ্ছে। যা বাজেট ঘাটতি বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে এসব পণ্যের মূল্য সমন্বয় করা হলে আবারও মূল্যস্ফীতি বাড়বে। সেটাকে কোন প্রক্রিয়ায় সহনীয় রাখা হবে। ভোক্তাদের দুর্ভোগ কমাতে কী ধরনের নীতি গ্রহণ করা হবে বা কোনো নীতির পরিবর্তন করা হবে কি না-বিশেষ করে মুদ্রানীতি ও ফিস্ক্যাল নীতিতে কোনো পরিবর্তন আনা হবে কি না-সে বিষয়েও বিশদ পরিকল্পনা জানতে চাওয়া হয়েছে। আইএমএফ চায় পাঁচটি আইনের সংশোধন। ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) আইন, ২০২৩ গত ২৮ মার্চ অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা কমিটি। এটা এখন সংসদে পাঠানো হবে। এর খসড়া কপি চেয়েছে আইএমএফ। যা তারা সংস্থাটির সদর দফতরে পাঠাতে চায়। এ ছাড়া হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন, ১৮৮১-এর সংশোধন, দেউলিয়া আইন, ১৯৯৭-এর সংশোধন, আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন, ১৯৯৩-এর সংশোধন, অর্থঋণ আদালত আইন, ২০০৩-এর সংশোধনী দ্রুত করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। অবশ্য এসব আইনের সংশোধনীর খসড়া চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে বলে সংস্থাটিকে জানানো হয়েছে। এ ছাড়া শর্ত অনুযায়ী, আগামী জুন ও সেপ্টেম্বরের মধ্যে যেসব শর্ত পরিপালনের কথা এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মধ্যে যেসব শর্ত পূরণ করার কথা সেগুলোর অগ্রগতি সম্পর্কে লিখিত তথ্য প্রতিনিধি দলকে সরবরাহ করতে হবে। এমনকি এসব শর্ত পূরণে বাজেটে কী উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে তার বিস্তারিত বিবরণ দিতে হবে। এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সরকার তো বলছে আইএমএফের দেওয়া সব শর্ত সরকারেরই দেওয়া। সরকার নাকি সেগুলো আগে থেকেই পালন করে আসছে। হ্যাঁ, এটা অনেকাংশে সত্য। তবে এটা আরও সত্য যে, আমরা এগুলোর কথা অনেক আগে থেকেই বলে আসছি। কিন্তু সরকার তা আমলে নেয়নি। ফলে এখন চাপে পড়ে যদি এসব সংস্কারমূলক কার্যক্রম পুরোপুরি পালন করা হয়, তবে দেশের অর্থনীতির জন্য ভালোই হবে বলে তিনি মনে করেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর