বৃহস্পতিবার, ১৮ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

সামাজিক সুরক্ষা নিয়ে সরকার আইএমএফ মুখোমুখি

মানিক মুনতাসির

সামাজিক সুরক্ষা নিয়ে সরকার আইএমএফ মুখোমুখি

সরকারি গবেষণা সংস্থা বিআইডিএস বলছে, দেশে নতুন করে দেড় কোটি মানুষ হতদরিদ্রের শিকার হয়েছেন। এর কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে বৈশ্বিক অচলাবস্থা ও করোনা মহামারি। বাংলাদেশের এই বিপুলসংখ্যক দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় আনতে প্রতি বছর বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানো হয়। এ বছরও এ খাতে প্রায় ৬ শতাংশ বরাদ্দ বৃদ্ধির প্রস্তাব করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

অর্থবিভাগের সূত্রগুলো বলছে, প্রতি বছর বাজেটের সময় দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে খাদ্য নিরাপত্তা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আর্থিক সেবার আওতায় আনতে সামাজিক নিরাপত্তা খাতকে বিস্তৃত করার পরিকল্পনা করে সরকার। কিন্তু তার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন নিয়ে প্রায় সব সময় প্রশ্ন তুলে আসছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। অব্যাহত অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের অর্থের অপচয় ঘটে এমন অভিযোগ তোলেন বিশ্লেষকরা। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২১ লাখ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। এর মধ্যে ১৪ লাখ সক্রিয় রয়েছেন। বাকিরা নানা কারণে ছুটি, অবসরে রয়েছেন। এই অবসরকালীন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সরকার (অবসরকালীন ভাতা) পেনশন দিয়ে আসে, যা সামাজিক নিরাপত্তা খাতের ব্যয় হিসেবে দেখানো হয়। আইএমএফ এটাকে সামাজিক নিরাপত্তার বাইরে হিসাব করার পরামর্শ দিয়ে আসছে। কিন্তু সরকার তা আমলে নিচ্ছে না। আসছে বছরের (২০২৩-২৪) বাজেটেও পেনশনভোগীদের সামাজিক সুরক্ষা খাতের মধ্যেই দেখাতে চায় সরকার। তবে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের বিপরীতে আইএমএফ সরকারকে কিছু শর্ত দিয়েছে, যা পরিপালনও করছে সরকার। এর অংশ হিসেবে গ্যাস-বিদ্যুতের দামও বাড়ানো হয়েছে। তবে বিপত্তি বেধেছে সামাজিক সুরক্ষা খাত নিয়ে। এই তহবিল প্রতি বছর বাড়ানোর সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে আইএমএফ। সংস্থাটি বর্ধিত ঋণ সুবিধার (ইসিএফ) ঋণের শর্তে বলা হয়েছে, চলতি বছর মার্চের মধ্যে ৬০ কোটি ৫ লাখ টাকা, জুনে ১০৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা, সেপ্টেম্বরের মধ্যে ১৫ কোটি ৫ লাখ টাকা এবং ডিসেম্বরের শেষে ৩০ কোটি ৯৯ লাখ টাকা বাড়াতে হবে। এদিকে অর্থবিভাগের তথ্যমতে, সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, আসছে জাতীয় বাজেটে সরকার সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির খরচ ৫ দশমিক ৩০ শতাংশ বাড়াতে যাচ্ছে। বর্ধিত ঋণ সহায়তার (ইসিএফ) শর্তের আওতায় সামাজিক সুরক্ষা তহবিলে প্রতিবছর খরচ বাড়ানোর সীমা বেঁধে দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। কিন্তু পেনশনের তহবিল সামাজিক সুরক্ষা তহবিলে না দেখানোর শর্ত মেনে নিয়েছে সরকার।

বিষয়টি বাস্তবায়ন করবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ও দেখা দিয়েছে। যদিও ভবিষ্যতে সামাজিক সুরক্ষা খাতের অর্থের সুষ্ঠু ব্যবহারের কোনো দিকনির্দেশনা নেই। আসছে বছরের বাজেটের প্রস্তুতি প্রসঙ্গে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে একাধিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।

তাঁর সঙ্গে অনুষ্ঠিত অর্থবিভাগের এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী কয়েকটি নির্দেশনা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আগামী বছর বাজেটের আয়-ব্যয় উপস্থাপনের বৈঠকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে তার দর্শন বিষয়ে বলেছেন, দেশের সামাজিক নিরাপত্তার কর্মসূচি আওতা আরও বাড়ানো দরকার।

 যাতে দেশের অসহায় এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উপকারভোগীরা সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় একটু হলেও আর্থিক সুবিধাটা পান। দেশের দরিদ্র এবং দুর্বল জনগোষ্ঠীর জন্য মোট ১ লাখ ১৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হবে বলে জনিয়েছেন অর্থবিভাগের কর্মকর্তারা। এ ছাড়াও বয়স্ক জনসংখ্যা এবং বিধবাদের জন্য বর্তমান ভাতার পরিমাণ আগামী অর্থবছর ২০২৩-২৪ থেকে বাড়ানো হচ্ছে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে সরকার সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির জন্য ১ লাখ ১৩ হাজার টাকার তহবিল বরাদ্দ করেছিল, যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ দশমিক ৫৫ শতাংশ। আগের অর্থবছর ২০২১-২২ বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ৭ হাজার কোটি টাকা, যা ছিল জিডিপির ৩ দশমিক ১১ শতাংশ।

এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সামাজিক সুরক্ষা বলতে আমরা শুধু কিছু চাল, আটা, গম বিতরণকেই বোঝাই। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো- এটা এ খাতের একটা ছোট অংশ মাত্র। এর একটা বড় অংশ হলো দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যের সুরক্ষা ও শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা এবং তার সঙ্গে অবশ্যই খাদ্য নিরাপত্তা ও বাসস্থানের নিরাপত্তা বিধান করা। আধুনিক এই যুগে আমরা এখনো মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারিনি। এটা খুবই হতাশাজনক বলে তিনি মনে করেন। অর্থবিভাগের এক সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের এ খাতে ১ লাখ ১৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছি, যা বর্তমান বাজেটের তুলনায় প্রায় ৬ শতাংশ বেশি। আওতা বাড়ানোর পাশাপাশি প্রতিটি সুবিধাভোগীর জন্য ভাতার পরিমাণ বাড়ানো হবে। প্রস্তাব অনুযায়ী, বয়স্কভাতার আওতায় ৫ লাখ ৭০ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৫ লাখ ৮০ হাজার জন করা হতে পারে। এ ছাড়া বয়স্ক জনগোষ্ঠীর বর্তমান ভাতা ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬০০ টাকা করা হবে। বর্ধিত সামাজিক সুরক্ষার আওতায় এবং ইউনিট বরাদ্দের জন্য আসন্ন জাতীয় বাজেটে অতিরিক্ত ৭৬১ কোটি টাকার তহবিল প্রয়োজন বলে অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

বিধবাদের জন্য বরাদ্দ বর্তমান ৫৫০ টাকা থেকে পরবর্তী অর্থবছরে জনপ্রতি ৬০০ টাকায় উন্নীত করা হবে। চলতি অর্থবছরে ২ লাখ ৪৭ হাজার থেকে আসন্ন অর্থবছরে ২ লাখ ৭৫ হাজার বিধবাকে এর আওতায় আনার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে বিধবাদের ভাতা বাড়াতে বাজেটে অতিরিক্ত ২১৬ কোটি টাকার তহবিল প্রয়োজন। প্রতিবন্ধী ও শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর জন্য সরকার বর্তমান বরাদ্দ থেকে আগামী বাজেটে ৫৫০ কোটি টাকা অতিরিক্ত বরাদ্দের পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

সর্বশেষ খবর