‘জার্মানি ফেরত মেয়ের জন্য পাত্র চাই। নিজের নামে দুই তলা বাড়ি আর তিন বিঘা জমি আছে। ইনসানা রুহি। বয়স ২৯ বছর। ডিভোর্সি। কফিশপ আছে। গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া। যে কোনো জেলার ভালো একজন পাত্র পেলে বিয়ে করে বিদেশে নিয়ে যাবেন। ফেসবুক কমেন্টে দেওয়া লিংকে ক্লিক করে মোবাইল নম্বর আর ঠিকানা সংগ্রহ করা যাবে।’
কিন্তু লিংকে ক্লিক করলে তা নিয়ে যাচ্ছে বিদেশি মুদ্রা (ফরেক্স) বা ক্রিপ্টোকারেন্সি বেচাকেনা এবং বিভিন্ন অনলাইন জুয়ার সাইটে। কখনো নিয়ে যাচ্ছে এমন ওয়েবসাইটে, যেখানে রয়েছে অসংখ্য সুন্দরী মেয়ের ছবি। ছবি নিয়ে ভিডিও কল করুন লেখা বাটনে ক্লিক করলেই নিয়ে যাচ্ছে জুয়ার সাইটে। বাংলাদেশিদের জুয়ায় আকৃষ্ট করতে ফেসবুকে প্রতিনিয়ত দেওয়া হচ্ছে এমন ‘হানিট্র্যাপ’। ফেসবুকে ‘পাত্রী চাই’ লিখে সার্চ করে কয়েক ডজন পোস্ট পাওয়া গেছে। প্রতিটি পোস্টে একটি সুন্দরী মেয়ের ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিবরণ একই, শুধু কোথাও বয়স বদলেছে, কোথাও পাত্রীর জমির পরিমাণ, আর কোথাও ছবি। এক ছবি দিয়ে কখনো জার্মানি ফেরত, কখনো ইতালি ফেরত, কখনো লন্ডন ফেরত পাত্রী দেখানো হয়েছে। আর লিংকগুলোয় ক্লিক করলে নিয়ে যাচ্ছে ক্রিকিয়া, জিতবাজ, বাবু ৮৮, বাজি, সিক্স৬ বিডি, সিক্স৬এসবিডিটি অনলাইনের মতো জুয়ার সাইটে। চলতি বছরের শুরুতে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল দেশে অন্তত ৫০ লাখ মানুষ অনলাইনে জুয়ায় আসক্ত।
এদিকে অনলাইন ভেরিফিকেশন ও মিডিয়া গবেষণা প্ল্যাটফর্ম ডিসমিসল্যাব সার্চ করে গত জুলাই থেকে ফেসবুকের বিভিন্ন পেজে ‘বিদেশফেরত পাত্রীর জন্য পাত্র চাই’- এমন ৪৩০টি পোস্ট পেয়েছে। এদের মধ্যে ৩৯৭টি অর্থাৎ ৯২ শতাংশই জুয়া বা বিদেশি মুদ্রা লেনদেনের সাইটে নিয়ে যায়। পোস্টগুলো শেয়ারের পরিমাণও অবিশ্বাস্য। শুধু ফেসবুক নয়, ইউটিউবে কোনো ভিডিও দেখতে গেলেই হুট করে হাজির হচ্ছে জুয়ার বিজ্ঞাপন। এসব বিজ্ঞাপনে বাংলাদেশি সংবাদ পাঠিকা দীপ্তি চৌধুরী, ভারতীয় ইন্টারনেট ব্যক্তিত্ব ঐশ্বরিয়া রুপারেল, পাকিস্তানি মডেল ও ইনফ্লুয়েন্সার মালাইকা বাতুল, বাংলাদেশের ক্রিকেটার সাবিক আল হাসানসহ আরও অনেক সেলিব্রেটির ছবি ও এআই ভিডিও তৈরি করে জুয়ার প্রচারণা চালাতে দেখা গেছে। বছরখানেক ধরে ইউটিউবে সর্বাধিক জুয়ার বিজ্ঞাপনে দেখা গেছে সাকিব আল হাসানকে। এইআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বানানো ওইসব ভিডিওতে সাকিবকে বলতে শোনা যায়, তিনি বেটিং করে লাখ লাখ টাকা আয় করছেন। নতুন জুয়াড়ি হিসেবে নাম লেখালেই ৪২ হাজার টাকা পর্যন্ত বোনাস দেওয়ার লোভনীয় প্রস্তাবও দেওয়া হচ্ছে। একইভাবে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ওয়েসবাইটেও জুয়ার বিজ্ঞাপন চলে আসছে। চলতি বছরের প্রথমার্ধে ডিসমিসল্যাবের গবেষণায় ১১টি সরকারি ওয়েবসাইটে ৩ হাজারের বেশি বেটিং ওয়েবপেজের সন্ধান পাওয়া গেছে।
অনুসন্ধানে দেখে গেছে, বাংলাদেশে জুয়ার বিস্তার ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। পাড়ার চায়ের দোকানে বসে বাজি ধরা হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। বেটিং সাইটে বিভিন্ন খেলার ওপর বাজি ধরা ছাড়াও অনলাইনে লুডুসহ বিভিন্ন গেম খেলেও অর্থকড়ি খোয়াচ্ছে অসংখ্য মানুষ। এদের অধিকাংশই বয়সে তরুণ। পাড়া-মহল্লায় তরুণ থেকে বৃদ্ধ সবাই খেলছে অনলাইনে জুয়া। দরিদ্র রিকশাচালক থেকে ধনীর দুলাল কেউ বাদ যাচ্ছে না এই নেশা থেকে। অভিযোগ রয়েছে, অনলাইনকেন্দ্রিক এসব জুয়ার মাধ্যমে দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে। প্রযুক্তিবিদরা বলছেন, অনলাইনে গেম বা জুয়া খেলে লাভবান হওয়ার নজির খুবই কম। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এগুলো প্রতারক ওয়েবসাইট। একটা নির্দিষ্ট সময় পর টাকা-পয়সা হাতিয়ে সাইট বন্ধ হয়ে যায়। এরপর নতুন নামে নতুন সাইট খোলা হয়। রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকার রংমিস্ত্রি হাবিব। বিশ্বের অধিকাংশ ফুটবল ক্লাবের নাম তার মুখস্থ। হড়হড় করে বলে দিতে পারেন যে কোনো ক্লাবের সাইডবেঞ্চে থাকা অখ্যাত ফুটবলারদের নামও। প্রতিদিন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে চলা ফুটবল ও ক্রিকেট ম্যাচ নিয়ে বাজি ধরতে গিয়ে তিনি এখন খেলার জগতের উইকিপিডিয়া। শুধু হাবিবই নয়, ওই এলাকার অধিকাংশ রিকশাচালক, চায়ের দোকানদাররাও রাখেন সব খেলার খোঁজখবর। চায়ের দোকানগুলোতে বসেই চলে লাখ লাখ টাকার বাজি। জুয়ার পাশাপাশি টাকা দিয়ে অনলাইনে লুডুসহ বিভিন্ন গেম খেলছে তরুণরা, যাদের অধিকাংশই শিক্ষার্থী। এ জন্য তাদের মোবাইলে ইনস্টল করা বিভিন্ন অ্যাপ। গত সোমবার ভাটারা এলাকায় একটা চায়ের দোকানের পেছন দিকে মোবাইলে নিমগ্ন চার যুবকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তারা লুড বিডি নামের একটা অনলাইন গেম খেলছে। এটা টাকা দিয়ে কয়েন কিনে খেলতে হয়। ইউটিউবে একটা ভিডিও দেখে তাদের মধ্যে স্বপ্ন তৈরি হয়েছে। এখানে লুডু খেলে কোনো এক সময় প্রতিদিন অন্তত ৫ হাজার টাকা আয় করার স্বপ্ন দেখছেন তারা।
গেমিং, স্পোর্টস ও গ্যাম্বলিং বিষয়ক ওয়েবসাইট প্লেটুডের মতে, অনলাইন ক্যাসিনোতে কোনো খেলোয়াড়কে নিয়ে আসতে পারলে অ্যাফিলিয়েট বা প্রচারকরা প্রতি খেলোয়াড়ের জন্য ৫০ থেকে ৪০০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত কমিশন পেয়ে থাকেন। অনেক ক্ষেত্রে যে খেলোয়াড়দের নিয়ে আসা হয়, সেসব খেলোয়াড়দের ব্যয় করা অর্থের ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন পেয়ে থাকেন এই অ্যাফিলিয়েটরা।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের তথ্যপ্রযুক্তি অবকাঠামো বিভাগের প্রধান জয়দেব কুমার মৃধা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এসব জুয়ার সাইট বা গেমিং সাইটে ই-মেইল দিয়ে অ্যাকাউন্ট করতে হয়। খেলার জন্য অর্থ লেনদেনে এমএফএস বা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করা হয়। এতে ওই ক্রেডিট কার্ড ঝুঁকিতে পড়ে। এ ছাড়া এই সাইটগুলো মূলত সিঙ্গাপুর, দুবাই ও ফিলিপাইন থেকে চালানো হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব সাইটে লাভবান হওয়া যায় না। টাকাটা বিদেশে চলে যায়। এ ছাড়া এসব সাইটে লগইন করার সময় বিভিন্ন পাসওয়ার্ড হ্যাকিংয়ের ঝুঁকি প্রবল।