অনিরাপদ হয়ে উঠেছে দেশের মহাসড়কগুলো। প্রায়ই ঘটছে ছিনতাই এবং ডাকাতির ঘটনা। মূল্যবান জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি দুর্বৃত্তরা হামলে পড়ছে যাত্রীদের ওপর। আবার টার্গেট করা ব্যক্তিকে খুন করতে হাইওয়েকে বেছে নেওয়া হচ্ছে- এমন অভিযোগও আসছে। অভিযোগ রয়েছে- মহাসড়কে রাত ২টার পর থেকে পুলিশি টহল খুঁজে পাওয়া যায় না। হাইওয়ে পুলিশ সদস্যরা সড়কের বিভিন্ন পেট্রলপাম্প কিংবা বাজারে বসে থাকছেন। রাতে আক্রান্ত যাত্রী এবং গাড়িচালকরা ৯৯৯-এ ফোন দিয়েও প্রত্যাশিত পুলিশি সহায়তা পাচ্ছেন না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কেবল হাইওয়ে পুলিশের ওপর নির্ভর না করে জেলা পুলিশকেও এ ব্যাপারে কঠোর তদারকির মধ্যে আনতে হবে।
হাইওয়ে পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি সরদার তমিজ উদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মহাসড়কের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতির লক্ষ্যে ছাড় দেওয়া হবে না। সারা জীবন এখানে থাকার জন্য আসিনি। তবে ৬ হাজার জনবলের মধ্যে মাত্র ৩ হাজার আমাদের কাছে আছে। প্রাপ্ত জনবল দিয়েই আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। জনবলের জন্যও উচ্চ পর্যায়কে বলেছি। ‘রাত ১২টার পর সড়কে পুলিশের উপস্থিতি থাকে না’- এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, এ বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা হবে। কোনো ধরনের বিচ্যুতি মেনে নেওয়া হবে না।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের গত সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে সারা দেশে ৪৫০-এর বেশি ডাকাতি ও দস্যুতার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় ৩ শতাধিক মানুষ আহত হয়েছে। শুধু রাজধানীতেই ডাকাতি ও দস্যুতায় জড়িত আছে ৫ শতাধিক দুর্বৃত্ত। এদের বেশির ভাগ ভাসমান। তারা অপরাধ করে পালিয়ে যায়। বিভিন্ন সড়কের পাশে থাকা বস্তিতেও আত্মগোপনে থাকে তারা। ঢাকা-সিলেট হাইওয়েতে নরসিংদী জেলার ইটাখোলা এবং মরজালসহ অন্তত পাঁচটি পয়েন্টে ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। গভীর রাতে প্রাইভেটকার এবং মাইক্রোবাসে হামলে পড়ছে দুর্বৃত্তরা।
গত সোমবার ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় আট সমন্বয়ক। গতকাল এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তবে ঘটনায় আরও অনেকে জড়িত থাকার তথ্য দিয়েছে গ্রেপ্তাররা। তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে দাবি করেছেন সোনারগাঁ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ আবদুল বারি। গত ২৭ নভেম্বর অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম আলিফের কবর জিয়ারত শেষে ফেরার পথে আনুমানিক সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চুনতি ইউনিয়নের হাজী রাস্তার মোড়ে সমন্বয়ক হাসনাত এবং সারজিসের গাড়িকে চাপা দিয়ে তাদের হত্যাচেষ্টার অভিযোগ ওঠে। গত ৫ ডিসেম্বর ঢাকা-সিলেট হাইওয়েতে নরসিংদীর রায়পুরা এবং কিশোরগঞ্জের ভৈরব সীমান্তে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। কুয়েতফেরত হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে দুই প্রবাসী বাড়ি যাচ্ছিলেন ভাড়া করা মাইক্রোবাসে। গাড়ি এবং চালক একই গ্রামের নূরুদ্দীন। গতকাল এ প্রতিবেদককে বলছিলেন, ডাকাতেরা আমাদের মারধর করেছে। ভাঙচুর করেছে গাড়ি। ছিনিয়ে নিয়েছে যাত্রীদের সঙ্গে থাকা মূল্যবান জিনিসপত্র। বিশেষ করে ওয়ালেদ নামের প্রবাসীকে প্রচুর মারপিট করেছে। কথাবার্তার এক পর্যায়ে কাঁদতে শুরু করেন তিনি। ডাকাতির এক পর্যায়ে আমরা ব্রিজ পার হয়ে ভৈরব মিন্টু পাম্পের সামনে থাকা পুলিশের কাছে সাহায্য চাই। তারা বলে, ঘটনাস্থল রায়পুরা। তাদের কিছুই করার নেই। তাদের কাছে নম্বর চাই। তারা নম্বরও দেয়নি। পরে ৯৯৯-এ ফোন করি। কেউ আসে না। এক পর্যায়ে সেনাবাহিনীর একটি গাড়ি আসে। তাদের সহায়তায় আমরা রায়পুরা থানায় যাই। তাদের বক্তব্য লিখে রাখে। গত ২০ দিনে আমাদের পরিচিত আরও চারটি মাইক্রোবাসে ডাকাতি হয়েছে। নরসিংদী এলাকাতেই।
পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক আওলাদ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা রাতে টহলের ওপর জোর দিচ্ছি।
গত ৬ অক্টোবর দুপুর দেড়টার দিকে রপ্তানি পণ্য নিয়ে সীতাকুন্ডের নেমশন ডিপোতে অবস্থান করলে কিছু দুষ্কৃতকারী তিনটি গাড়ির (ঢাকা মেট্রো-ট-২০-১৮৫৫, ঢাকা মেট্রো-ট-১৮-০০১৮ ও ঢাকা মেট্রো-ট-২০-৭২৫১) ভিতর থেকে গাড়ির ডকুমেন্ট চুরি করে নিয়ে যায়। পরে তিন গাড়ির চালককে অজ্ঞাত নম্বর থেকে ফোন করে ডকুমেন্টস ফেরত নেওয়ার জন্য ১৫ হাজার টাকা করে ৪৫ হাজার টাকা দিতে বলে। গত ১১ নভেম্বর সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য লোড করে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেয় আরমান ট্রেডার্সের একটি গাড়ি (চট্টগ্রাম মেট্রো-ট-১১-৭০২৬)। গাড়িটি রাত সাড়ে ৯টার সময় চট্টগ্রামের মিরসরাই বাজার এলাকায় এলে কিছু দুষ্কৃতকারী হামলা করে। দুষ্কৃতকারীরা চালকের মোবাইল, মানিব্যাগ কেড়ে নিয়ে গাড়িটি ছিনতাইয়ের চেষ্টা করে। চালক ৯৯৯-এ কল দিলে দুষ্কৃতকারীরা চালককে কুপিয়ে জখম করে এবং গাড়ির গ্লাস ভেঙে পালিয়ে যায়। সম্প্রতি হাইওয়ে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে মহাসড়কে এমন অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
গত শনিবার দিবাগত রাতে পুরান ঢাকার কদমতলী এলাকায় দুর্বৃত্তদের গুলিতে মনির হোসেন সানি ও আলমগীর নামে দুই নিরাপত্তাকর্মী আহত হয়েছেন। তারা এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দলবদ্ধভাবে মালামাল লুটের ঘটনায় অপরাধী পাঁচজনের বেশি হলে ডাকাতি আর কম হলে দস্যুতার মামলা হয়। ঢাকায় ২০২৩ সালে দস্যুতার ঘটনায় ১৯৯টি মামলা হয়। এ বছর ছিনতাইয়ের ১০৩টি মামলা হয়। গত বছর সাসপেক্ট আইডেন্টিফিকেশন অ্যান্ড ভেরিফিকেশন সিস্টেম (এসআইআইভিএস) নামের একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে ডিএমপি অপরাধীদের তথ্যভান্ডার গড়ে তোলে। তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, রাজধানীতে ছিনতাইয়ের সঙ্গে ১ হাজার ৭৩৭ জন যুক্ত। ডাকাতি দস্যুতার সঙ্গে যুক্ত ছিল ৪৫০-এর বেশি দুর্বৃত্ত। ওই হিসেবে সবচেয়ে বেশি ডাকাত ও ছিনতাইয়ের মতো অপরাধী বেশি ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগে।
ডিএমপি কমিশনার মো. সাজ্জাত আলী বলেন- বিভিন্নভাবে আমাকে জানানো হয়েছে- ছিনতাই বেড়েছে। প্রতিরোধে ডিবি ও থানা-পুলিশকে সক্রিয় করা হয়েছে। হাইওয়ে পুলিশ বলছে, ৩৩টি রুটে তাদের ৮৫টি টহল টিম চালু রয়েছে। মহাসড়ক সচল রাখতে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছে হাইওয়ে পুলিশ।