টাঙ্গাইলের সরকারি এম এম আলী কলেজের অনার্স তৃতীয় বর্ষের অ্যাকাউন্টিংয়ের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ খোকন মিয়া। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেওয়ার এক পর্যায়ে আগারগাঁওয়ে পুলিশের ছররা গুলিতে চোখে মারাত্মক আঘাত পান। ঢাকায় চিকিৎসা শেষে নিজ এলাকা টাঙ্গাইলে ফিরে গেছেন। চিকিৎসকরা বলেছেন, তাঁর চোখের কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করতে হবে। আর কর্নিয়া নেপাল থেকে আনতে হবে। কিন্তু কর্নিয়া কবে আসবে আর কবেই বা তাঁর চোখ ঠিক হবে এখন সে দুশ্চিন্তায় মানসিক যন্ত্রণায় আছেন খোকন। প্রায়ই আন্দোলনের সময় ঘটে যাওয়া সহিংসতার দৃশ্যগুলো মনে করে তিনি অস্থির হয়ে ওঠেন, মন খারাপ হয়।
খোকনের মতোই জুলাই-আগস্ট গণ আন্দোলনের অনেক শিক্ষার্থী পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসওর্ডার (পিটিএসডি), উদ্বেগ এবং বিষণœতায় ভুগছেন বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। এতে অনেকের ব্যক্তিত্বে পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। আন্দোলনে ঘটে যাওয়া সহিংসতার কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরনের ট্রমাটিক পরিবেশ তৈরি হচ্ছে, একে বলা হয় পিটিএসডি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্দোলনের ছয় মাসের মধ্যেই এর উপসর্গ দেখা দেওয়ার কথা। কিন্তু এরই মধ্যে শিক্ষার্থীদের শরীরে বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য উপসর্গ দেখা দিতে শুরু করেছে। আশঙ্কা, এ শিক্ষার্থীরা এক থেকে দুই মাসের মধ্যেই পিটিএসডিতে আক্রান্ত হবেন কিংবা অনেকে এরই মধ্যে আক্রান্ত হয়েছেন। এর ফলে আগামী বছর পিটিএসডিতে আক্রান্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যা বা বিষণœতার হার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে বিশেষজ্ঞরা জুলাই গণ অভ্যুত্থানে যেসব ছাত্র-জনতা আহত হয়েছে এবং যারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত তাদের তালিকা তৈরি করে মানসিক সেবা দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এর অংশ হিসেবে আন্দোলনে নিহতদের পরিবারের সদস্যদের সরকারি/বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দিতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ও মনোচিকিৎসকের সমন্বয়ে সব জেলা-উপজেলায় সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে একটি মানসিক স্বাস্থ্য কর্নার তৈরি করতে হবে। স্কুল, কলেজ, আলিয়া ও কওমি মাদরাসা, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের জন্য ট্রমা রিকভারি কর্মশালা, মানসিক স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সচেতনতামূলক কার্যক্রমের ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারি উদ্যোগে একটি ‘হটলাইন সেবা’ চালু করতে হবে যার মাধ্যমে সব এলাকার ছাত্র-জনতা মনোবেদনা শেয়ার করতে পারে। এ ছাড়া একটি গবেষণা শেল গঠন করতে হবে যার মাধ্যমে সেবা প্রদান-পরবর্তী পুরো সময়ের গবেষণালব্ধ তথ্য জাতীয়ভাবে সংরক্ষণ করা যাবে। ‘মেন্টাল হেলথ ইমপ্যাক্ট ওন প্রোটেস্টর অ্যান্ড ভিকটিমস ফ্যামিলিস অব দ্য জুলাই মুভমেন্ট-২০২৪ ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণায় বলা হয়, জুলাই ও আগস্টের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক জীবনে যেমন ব্যাঘাত ঘটছে, একইভাবে তাদের ঘুম ও মনোযোগেও বিঘ্ন ঘটছে। এতে আরও বলা হয়, স্কুলগামী শিক্ষার্থী, শিশু-কিশোর, তরুণরাই এ আন্দোলনের মূল অংশগ্রহণকারী ছিল। এতে অসংখ্য শিক্ষার্থী জীবন হারায়, কেউবা চিরতরে পঙ্গু হয়ে যায়। অনেকে মারাত্মক আহত হয়, কেউ দৃষ্টিশক্তি হারায়। এ ছাড়া যে শিক্ষার্থীরা সামনে থেকে সরাসরি এ আন্দোলনের সহিংস ঘটনা প্রত্যক্ষ করে তারা সবাই কমবেশি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। চিকিৎসকরা অনেকের মধ্যে ঘুমের ব্যাঘাত, ভয়, অস্থিরতার মতো উপসর্গ দেখতে পেয়েছেন।
শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের সভাপতি তানসেন রোজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের মাঝে উল্লেখযোগ্য একটি উপসর্গ এরই মধ্যে দেখা যাচ্ছে। শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে বিভিন্ন ধরনের দাবিদাওয়া আদায়ে বিক্ষোভ করছে। যা উপসর্গগুলোর একটি। এ আন্দোলনে যারা আহত হয়েছেন তাদের শারীরিক ক্ষতির চিকিৎসাসেবা দিতে সরকার চেষ্টা করলেও একই সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। এ ক্ষেত্রে তাদের কাউন্সেলিং বা ওয়ান টু ওয়ান সেবা দেওয়া দরকার ছিল। কিন্তু এ বিষয়টি শুরুর দিকে সেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এতে এখন আমরা শিক্ষার্থীদের মধ্যে সমস্যা দেখতে পাচ্ছি। আবার যারা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন তারা বিভিন্ন ধরনের ভয়ার্ত পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছেন। আমরা আশঙ্কা করছি এ শিক্ষার্থীরা এক থেকে দুই মাসের মধ্যেই পিটিএসডিতে ভুগতে পারেন। এর ফলে আগামী বছর এদের মধ্যে আত্মহত্যা বা বিষণ্নতার হার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পিটিএসডির কারণে শিক্ষার্থীরা যাতে আত্মহত্যা করতে না পারেন এজন্য এখনই সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।’