দশম শ্রেণির ছাত্র শাহরিয়ার খান আনাস গত বছর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের কয়েক ঘণ্টা আগে রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় পুলিশের গুলিতে নিহত হন। একটি বুলেট তার বুকের বাঁ পাশ দিয়ে ঢুকে পিঠ ভেদ করে বেরিয়ে যায়। সেদিন প্রায় একই সময়ে আরও কয়েকজন নিহত হন। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় প্রসিকিউশনের প্রথম সাক্ষী হিসেবে গতকাল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ সাক্ষ্য দিয়েছেন নিহত আনাসের বাবা শাহরিয়ার খান পলাশ।
জবানবন্দিতে তিনি বলেন, এক আন্দোলনকারীর ফোন পেয়ে আমি, আমার স্ত্রী এবং আমার শ্বশুর মিটফোর্ড হাসপাতালে যাই। সেখানে গিয়ে জরুরি বিভাগের সামনে একটি স্ট্রেচারে রক্তাক্ত অবস্থায় আমার সন্তানের গুলিবিদ্ধ লাশ দেখতে পাই। মামলার আসামিদের ঘটনার জন্য দায়ী করে তাদের ফাঁসি চান নিহত আনাসের বাবা। পরে আসামি আরশাদ হোসেনের পক্ষে সাক্ষীকে জেরা করেন আইনজীবী সাদ্দাম হোসেন অভি। ইমাজ হোসেনের পক্ষে জেরা করেন আইনজীবী জিয়াউর রশিদ টিটো, আসামি সুজন হোসেন ও নাসিরুল ইসলামের পক্ষে জেরা করেন আইনজীবী আবুল হোসেন। আর পলাতক আসামিদের পক্ষে জেরা করেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী কুতুবুদ্দিন। আজ এ মামলা ফের সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ধার্য রয়েছে।
এর আগে বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ মামলার সূচনা বক্তব্য তুলে ধরেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। ট্রাইব্যুনালের দুই সদস্য হলেন- বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। এ সময় প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম, গাজী এম এইচ তামীম, বি এম সুলতান মাহমুদ, আবদুস সাত্তার পালোয়ান ও তারেক আবদুল্লাহ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ পুলিশের সাবেক আট সদস্য এ মামলার আসামি। তাদের মধ্যে চারজন পলাতক। তারা হলেন সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, সাবেক যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, রমনা অঞ্চলের সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহ্ আলম মো. আখতারুল ইসলাম ও রমনা অঞ্চলের সাবেক সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ ইমরুল। গ্রেপ্তার আসামিরা হলেন শাহবাগ থানার সাবেক পরিদর্শক (অপারেশন) মো. আরশাদ হোসেন, কনস্টেবল মো. সুজন হোসেন, ইমাজ হোসেন ও মো. নাসিরুল ইসলাম। গতকাল মামলার বিচারকাজের সময় তারা ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় ছিলেন।
সূচনা বক্তব্যে চিফ প্রসিকিউটর জুলাই অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট ও মামলার আদ্যোপান্ত তুলে ধরে বলেন, ‘এই বিচার কার্যক্রম পুরোনো রাজনৈতিক বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য নয়, বরং একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থার প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া। এটি প্রমাণ করে যে, দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাবান ব্যক্তিদেরও আইনসম্মত জবাবদিহির আওতায় আনা যেতে পারে। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জনগণ বিশ্বাস করতে পারবে যে ন্যায়বিচার কোনো অবস্থাতেই পক্ষপাতদুষ্ট বা প্রভাবিত নয়, বরং সম্পূর্ণ স্বচ্ছ, দৃঢ় এবং নিরপেক্ষভাবে পরিচালিত হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ মামলায় প্রধান আসামি হিসেবে তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান অভিযুক্ত। বিচার প্রক্রিয়া ডিএমপি কমিশনারসহ সাত আসামির জন্য সর্বোচ্চ ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে। বিচার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী পরিচালিত হবে। যাতে সব পক্ষের আইনি অধিকার নিশ্চিত হয়। এ ধরনের সুষ্ঠু বিচারব্যবস্থা দেশের আইনি সংস্কৃতির প্রতি জনগণের আস্থাকে আরও দৃঢ় করবে এবং ন্যায়বিচারের মূল্যবোধকে প্রতিষ্ঠিত করবে।’
জবানবন্দিতে যা বললেন নিহত আনাসের বাবা পলাশ : এ মামলায় প্রসিকিউশনের প্রথম সাক্ষী নিহত আনাসের বাবা শাহরিয়ার খান পলাশ তার জবানবন্দিতে বলেন, গত বছর ৫ আগস্ট মাকে একটি চিঠি লিখে সকালে রাজধানীর গেন্ডারিয়ার ভাড়া বাসা থেকে বের গিয়েছিল আনাস। চিঠিতে আনাস লিখেছিল ‘মা আমি মিছিলে যাচ্ছি। যদি না ফিরি তাহলে গর্বিত হইও।’ চিঠিটি তদন্ত কর্মকর্তা জব্দ করেছেন এবং তা এ মামলার জব্দ তালিকায় বস্তু প্রদর্শনী হিসেবে আছে। তিনি বলেন, ‘এই চিঠি পড়েই বুঝতে পারি আনাস বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচিতে গেছে। এরপর দুপুর দেড়টার দিকে আনাসের মায়ের মোবাইলে একটি অপরিচিত নম্বর থেকে কল আসে। ফোন ধরতেই জানতে চাওয়া হয় আমাদের কেউ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কর্মসূচিতে গেছে কি না। আমার স্ত্রী বলে, আমার ছেলে আনাস গেছে। ওই লোকটি তখন দ্রুত মিটফোর্ড (স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ) হাসপাতালে যেতে বলেন।’
আনাসের সঙ্গে থাকা সিম ছাড়া মোবাইল থেকে নম্বর নিয়ে ওই লোকটি ফোন দিয়েছিলেন বলে ট্রাইব্যুনালকে জানান সাক্ষী পলাশ। তিনি বলেন, ‘পরে জানতে পারি ওই লোকটিও আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী একজন ছাত্র। তার নাম সৌরভ আহম্মেদ।’ সিম ছাড়া মোবাইলটিও তদন্ত কর্মকর্তা জব্দ করেছেন এবং তা মামলার বস্তু প্রদর্শনী হিসেবে আছে জানিয়ে সাক্ষী বলেন, ‘এই সংবাদ শুনে আমি, আমার স্ত্রী এবং আমার শ্বশুর মিটফোর্ড হাসপাতালে যাই। জরুরি বিভাগের সামনে একটি স্ট্রেচারে রক্তাক্ত অবস্থায় আমার সন্তানের গুলিবিদ্ধ লাশ দেখতে পাই।’
আনাসের সঙ্গে থাকা আন্দোলনকারী রাব্বী হোসেন, সৌরভ আহম্মেদের বরাত দিয়ে গত বছর ৫ আগস্ট চানখাঁরপুল এলাকার পরিস্থিতির বর্ণনা দেন সাক্ষী শাহরিয়ার খান (পলাশ)। সকাল সাড়ে ১০টার বর্ণনায় তিনি বলেন, ‘তারা (আনাস, রাব্বি ও সৌরভসহ আন্দোলনকারীরা) চানখাঁরপুল হয়ে শহীদ মিনারের দিকে যাচ্ছিল। চানখাঁরপুল এলাকায় তারা পুলিশের বাধার মুখে পড়ে। সেখানে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা জড়ো হয়।’ জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ‘পুলিশ নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের ওপর সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ার শেল, শটগান এবং চাইনিজ রাইফেল দিয়ে নির্বিচারে গুলি করে। নিমতলীর নবাব কাটরা গলির ভিতর আনাসকে টার্গেট করে গুলি করে পুলিশ। একটা গুলি আমার ছেলের বুকের বাঁ পাশে বিদ্ধ হয়ে পেছন দিক দিয়ে বের হয়ে যায়। গুলি করা লোকটি এপিবিএনের পোশাক পরা ছিল।’ জবানবন্দিকে পলাশ বলেন, ‘আনাস গুলিবিদ্ধ হওয়ায় তাকে রাব্বি হোসেন, সৌরভ আহম্মেদসহ আরও কয়েকজন রিকশায় করে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যায়। রাব্বিসহ আরও অনেকেই ঘটনাটির ভিডিও করে। পরে ভিডিওগুলো আমাকে দেয়। তদন্ত কর্মকর্তা আমার কাছ থেকে তা জব্দ করেছেন।’ আনাসসহ ছয়জনকে গুলি করে হত্যার জন্য সাক্ষী শাহরিয়ার খান পলাশ আসামিদের দায়ী করে তাদের বিচার ও ফাঁসি দাবি করেন ট্রাইব্যুনালের কাছে।
গত বছর ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিন রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় আনাসসহ কয়েকজন পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। এ ঘটনায় মামলা দায়েরের পর ছয় মাস ১৩ দিনে তদন্ত শেষ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। গত ২০ এপ্রিল চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দেয় সংস্থাটি। এটিই ছিল জুলাই-আগস্টের গণ আন্দোলনে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার প্রথম তদন্ত প্রতিবেদন। পরে গত ২৫ মে এ মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হলে ট্রাইব্যুনাল তা আমলে নেন। এ মামলায় ৭৯ জনকে সাক্ষী করেছে প্রসিকিউশন। পরে গত ১৪ জুলাই আসামিদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। সেই ধারাবাহিকতায় গতকাল প্রসিকিউশনের সূচনা বক্তব্যের পর মামলার প্রথম সাক্ষীর সাক্ষ্য নিলেন ট্রাইব্যুনাল।