কারও কাছে আদালত ভবন, কারও কাছে দারুল আদালত, আবার কারও কাছে ভূতুড়ে বাড়ি- চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক পর্তুগিজ ভবন ঘিরে রয়েছে এমন নানা পরিচিতি। তবে এটি নিছক ভবন নয়, বরং মোগল ও পাশ্চাত্য স্থাপত্যশৈলীর সমন্বয়ে গড়া এক অনন্য স্থাপত্যকীর্তি। চট্টগ্রামের উপনিবেশিক ইতিহাস, শিক্ষা আন্দোলন ও ধর্মীয় সংস্কৃতির জীবন্ত দলিল এ স্থাপনাটি।
দ্বিতলবিশিষ্ট ভবনটির অবস্থান সরকারি মহসিন কলেজ ক্যাম্পাসের পাশের পাহাড়চূড়ায়। প্রায় ৪০০ বছরের পুরোনো এ ভবনকে কেউ কেউ ১৬৬৬ সালে পর্তুগিজ উপনিবেশের সময় নির্মিত বলে অভিমত প্রকাশ করেন, আবার কারও মতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে (১৭৬১)-এর নির্মাণ। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ২০০৯ সালের জরিপে এটি পর্তুগিজ স্থাপত্য হিসেবে চিহ্নিত হয়। এক সময় এটি ছিল প্রশাসনিক দুর্গ, সামাজিক কর্মকাণ্ড ও বিচার কেন্দ্র। ভবনের দেয়াল তিন ফুট পুরু, ইট-চুন-সিমেন্টে গাঁথা। রয়েছে ২০টি কক্ষ, দুটি সর্পিল সিঁড়ি, টাওয়ার ও গম্বুজ। ছাদ থেকে নজরদারি করা যেত গোটা চট্টগ্রাম। তবে বর্তমানে ভবনটি জরাজীর্ণ। পালেস্তারা খসে পড়ছে, ভিতরে সাপের গর্ত, চারপাশে ঝোপঝাড়। দর্শনার্থীরা আজ এটি দেখে ভূতুড়ে বাড়ির মতো মনে করেন। ইতিহাস বলছে, ১৮৫৭ সালের আগে পর্যন্ত এটি আদালত হিসেবে ব্যবহৃত হতো। পরে লালদীঘির লালকুঠিতে আদালত স্থানান্তরিত হয়। জানা যায়, ১৮৩৫ সালে দানবীর হাজী মুহাম্মদ মুহসীনের ওয়াকফ সম্পত্তি থেকে গঠিত হয় ‘মুহসীন ফান্ড’। সেই ফান্ড থেকে ১৮৭৪ সালের ২০ জুলাই চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠা করা হয় প্রথম ‘মোহসিনিয়া মাদরাসা’। ১৮৭৯ সালে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ ৩০ হাজার টাকায় ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে ভবনসহ পুরো পাহাড়টি কিনে নেয়। ১৯২৭ সালে মুহসীন কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন পর্তুগিজ ভবনটি কিছু সময়ের জন্য ছাত্রাবাস হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। ২০১৩ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এটিকে ঐতিহাসিক স্থান ঘোষণা করলেও এখনো সংরক্ষণে উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। চট্টগ্রাম ইতিহাস গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান আলীউর রহমান বলেন, ‘এটি নান্দনিক ও ঐতিহাসিক স্থাপত্য। সংরক্ষণ করা গেলে এটি হেরিটেজ মিউজিয়াম বা পর্যটন কেন্দ্র হতে পারে।’ শিক্ষার্থীদের মতে, সরকারি উদ্যোগ ছাড়া এ ঐতিহ্য রক্ষা সম্ভব নয়।
জনশ্রুতি আছে, ভবনের নিচ থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত সুড়ঙ্গ ছিল, যা দিয়ে লুটকৃত মাল আনা হতো কিংবা পর্তুগিজরা পলায়ন করত। ভবনের গোপন কক্ষে নাকি অস্ত্রশস্ত্র ও প্রমোদসভাও বসত।
আজ জরাজীর্ণ এ পর্তুগিজ ভবন দাঁড়িয়ে আছে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যের প্রতীক হয়ে। সংরক্ষণের অভাবে ইতিহাস যেন ধ্বংসস্তূপ মিলিয়ে যাচ্ছে। তাই প্রয়োজন সরকারি উদ্যোগে দ্রুত সংরক্ষণ ও পুনর্গঠন।