জুলাই-আগস্ট গণ অভ্যুত্থানে কুষ্টিয়ায় ছয়জনকে হত্যার ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে বিচার শুরুর আদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। গতকাল বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-২ পৃথক দুই মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফর্মালচার্জ) গঠন করে এ আদেশ দেন। একই সঙ্গে হানিফসহ চারজনের বিরুদ্ধে করা মামলায় সূচনা বক্তব্য ও সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ২৫ নভেম্বর ও ইনুর বিরুদ্ধে করা মামলায় ৩০ নভেম্বর দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল। ইনুর বিরুদ্ধে আটটি এবং হানিফসহ চারজনের বিরুদ্ধে তিনটি অভিযোগ এনেছে প্রসিকিউশন। ট্রাইব্যুনালে হাসানুল হক ইনুর পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী হানিফসহ পলাতক চারজনের পক্ষে ছিলেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে ছিলেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলামসহ অন্য প্রসিকিউটররা উপস্থিত ছিলেন। এদিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ চানখাঁরপুল মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন সিআইডির দুই ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ। পরে এ মামলায় পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ৯ নভেম্বর দিন ঠিক করে দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। এদিন ইনুর বিরুদ্ধে আনা আটটি অভিযোগ পড়ে শোনান ট্রাইবুনাল। এ সময় ট্রাইবুনাল ইনুর কাছে জানতে চান তিনি দোষী না নির্দোষ। জবাবে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ইনু বলেন, আমি সম্পূর্ণভাবে নির্দোষ। আমি রাজনৈতিক আক্রোশের শিকার এবং গায়েবি মামলার ঝড়ে বিধ্বস্ত। তিনি বলেন, আমি আশা করব, আল্লাহর পরে এই ট্রাইব্যুনাল ন্যায়বিচার করবেন। পরে অভিযোগ গঠনের আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। এরপর পলাতক মাহবুব উল আলম হানিফসহ চারজনের বিরুদ্ধে আনা তিনটি অভিযোগ পড়ে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। পরে তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। এর আগে গত ২৫ সেপ্টেম্বর জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুর বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করা হয়। ৩৯ পৃষ্ঠার অভিযোগের সঙ্গে রয়েছে ১ হাজার ৬৭৯ পৃষ্ঠার নথিপত্র। রয়েছে তিনটি অডিও ও ছয়টি ভিডিও ডকুমেন্ট। আর এ মামলায় একমাত্র আসামি করা হয়েছে হাসানুল হক ইনুকে। গত ২৮ অক্টোবর অভিযোগ গঠনের বিষয়ে শুনানি শেষে আদেশের জন্য গতকালের দিন ধার্য করেছিলেন ট্রাইব্যুনাল। আটটি অভিযোগে আন্দোলনকারীদের বিএনপি, জামায়াত, সন্ত্রাসী, সাম্প্রদায়িক ট্যাগ প্রদান করে এবং তাদের বিরুদ্ধে বল প্রয়োগের উসকানি, ১৪-দলীয় জোট সরকারের অংশীদার জাসদের সভাপতি হিসেবে তার ঊর্ধ্বতন অবস্থান থেকে সরাসরি সম্পৃক্ত থেকে ওই সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের নির্দেশ, প্ররোচনা দিয়েছেন, উসকানি এবং সহায়তা, কুষ্টিয়ায় পুলিশ সুপারকে ফোন করে আন্দোলন দমনের নির্দেশনার পর ছয়জনকে হত্যার কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে গত ৫ অক্টোবর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফসহ চারজনের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট তিনটি অভিযোগ এনে আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র জমা দেয় প্রসিকিউশন। পরে ৬ অক্টোবর অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। এই চার আসামির মধ্যে হানিফের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা হিসেবে ‘আন্দোলন দমনের জন্য ছাত্রলীগ যথেষ্ট’- ওবায়দুল কাদেরের এমন বক্তব্য দেওয়ার মিটিংয়ে উপস্থিত থেকে একমত পোষণ করা, ২৯ জুলাই কুষ্টিয়ায় একটি মিটিং করে ছাত্র-জনতাকে হত্যার নির্দেশ দেওয়া ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এবং ছয়জনকে হত্যা করার অভিযোগ আনা হয়েছে। হানিফ ছাড়া মামলার অন্য তিন আসামি হলেন- কুষ্টিয়া জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি সদর উদ্দিন খান, সাধারণ সম্পাদক আজগর আলী এবং সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আতাউর রহমান আতা। এ মামলার চার আসামিই পলাতক। এ মামলায় গত ২৮ অক্টোবর অভিযোগ গঠন শুনানি শেষ করেন আসামি পক্ষের আইনজীবী। সেদিনই আদেশের জন্য আজকের দিন ধার্য করা হয়েছিল।
দোষী-নির্দোষের বাইরে অন্য কোনো বক্তব্য আমলে নেওয়ার সুযোগ নেই :
পরে ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে ব্রিফিংয়ে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ইনুর বিরুদ্ধে আজ আটটি অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। আইনের বিধান হচ্ছে আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হয় যে আপনার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ গঠন হয়েছে।
আপনি কি নিজেকে নির্দোষ নাকি দোষী মনে করেন। নিজেকে দোষী বললে আদালত এটার ভিত্তিতে একটা রায় দিয়ে ফেলতে পারেন। আর নির্দোষ হলে মামলাটি বিচারে যাবে। সাক্ষ্যপ্রমাণের মাধ্যমেই তাকে প্রমাণ করতে হবে তিনি নির্দোষ। আর প্রসিকিউশন প্রমাণের চেষ্টা করবে তিনি দোষী। এই প্রশ্নের জবাবে তিনি একটা জবাবই শুধু দিতে পারবেন। সেটা হচ্ছে দোষী না নির্দোষ। এর বাইরে তিনি যেসব বক্তব্য দিয়েছেন তা আমলে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাজুল ইসলাম বলেন, ১৪-দলীয় জোটের অন্যতম শরিক দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি হিসেবে ইনু একজন প্রভাবশালী নেতা। জোটের মিটিংয়ে আন্দোলন দমনে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ, কারফিউ জারি, শুট অ্যাট সাইটের ব্যাপারে তার ভূমিকা ছিল। সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির কারণে তার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ গঠন হয়েছে। তিনি বিভিন্ন সময় উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন। ছাত্রদের সন্ত্রাসী, জামায়াত-শিবির, বিএনপি বলে হত্যা করার যৌক্তিক বা বৈধতা তৈরি করেছেন। ড্রোন-হেলিকপ্টার ব্যবহার, বোম্বিং করাসহ বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ফোনে কথা বলেছিলেন ইনু।
তিনি আরও বলেন, শেখ হাসিনাকে পরামর্শ দিয়েছেন ছাত্র-জনতাকে কীভাবে আটক করা উচিত। জেলে না পাঠিয়ে কী করা উচিত। আট নম্বর অভিযোগটা ছিল কুষ্টিয়া শহরে গত বছরের ৫ আগস্ট ইনুর নির্দেশে পুলিশ, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ মিলে ছয় ছাত্র-জনতাকে হত্যা করেছে।
চানখাঁরপুল মামলায় সাক্ষ্য দিলেন দুই ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ
জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের সময় চানখাঁরপুলে ছয়জনকে হত্যার ঘটনায় ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ আটজনের বিরুদ্ধে করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন সিআইডির দুই ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ। গতকাল বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ তারা সাক্ষ্য দেন। পরে তাদের জেরা শেষ করেছেন আসামি পক্ষের আইনজীবীরা। এ মামলায় পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ৯ নভেম্বর দিন ঠিক করেছেন ট্রাইব্যুনাল।
এদিন বেলা সাড়ে ১১টার পর সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। প্রথমে প্রসিকিউশনের ২১তম সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ রোকনুজ্জামান। তিনি পুলিশ পরিদর্শক হিসেবে সিআইডির ফরেনসিক বিভাগে কর্মরত রয়েছেন। পরে প্রসিকিউশনের ২২তম সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন একই সংস্থার ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাবের উপপরিদর্শক শাহেদ জোবায়ের লরেন্স। সাক্ষ্যে এ মামলায় উদ্ধার করা আলামত যাচাই-বাছাইয়ের বর্ণনা দেন তারা। এখন পর্যন্ত এ মামলায় মোট ২২ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন।