চীনের ইয়াংসি নদীর শেষ বৃহৎ প্রাণীগুলোর একটিকে বাঁচানোর জন্য লড়াই চালাচ্ছেন সে দেশের বিজ্ঞানীরা। এই অঞ্চলে মাছ ধরা পুরোপুরি নিষিদ্ধ যা তাদের এই লড়াইয়ে সহায়তা করছে।
ইয়াংসি নদীর তীর থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার (৩.১ মাইল) দূরে উহানের ‘ইনস্টিটিউট অফ হাইড্রোবায়োলজি’-তে বর্তমানে বিলুপ্ত ‘রিভার ডলফিন’ বা শুশুক (চীনা ভাষায় বাইজি) এবং প্যাডেল ফিশের দেহ কাচের ঘরে সংরক্ষিত অবস্থায় রাখা আছে।
সেগুলোর দিকে ইঙ্গিত করে প্রাণী বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ওয়াং শি বলেন, ‘এগুলো এখন বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে তাই আমরা ইয়াংসি নদীর পর্পয়েজকে বাঁচাতে চাইছি। এটাই এখন এখানকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী হয়ে উঠেছে।’
পর্পয়েজকে দেখতে অনেকটা শুশুকের মতো। কিছু পার্থক্য অবশ্য রয়েছে। ফিনলেস পর্পয়েজ বলার কারণ এদের ডোরসাল ফিন নেই।
এই প্রতিষ্ঠানের গবেষকরা রিভার ডলফিনের দেখাশোনা শুরু করার ২২ বছর পর, ২০০২ সালে শেষ চেনা বাইজির মৃত্যু হয়। এক বছর পরে, একটি প্যাডেল ফিশ দুর্ঘটনাক্রমে মৎসজীবীদের হাতে ধরা পড়ে। এই প্রজাতির মাছ বিশেষ পাখনাযুক্ত। এই পাখনা তিন মিটারেরও বেশি লম্বা হতে পারে।
মৎসজীবীদের হাতে পড়া ওই প্যাডেল ফিশের শরীরে রেডিও ট্যাগ লাগানো ছিল এবং সেটি ছেড়েও দেওয়া হয়েছিল। তা সত্ত্বেও নদী থেকে প্যাডেল ফিশ এখন অদৃশ্য হয়ে যায়।
চীনা বিজ্ঞানীদের এখন লক্ষ্য হল ইয়াংসি নদীর ফিনলেস পর্পয়েজ বা পাখনাবিহীন পর্পয়েজের যাতে একই পরিণতি না হয়, তা নিশ্চিত করা।
অধ্যাপক ওয়াং শি ব্যাখ্যা করেছেন, ‘এটাই নদীতে অবশিষ্ট একমাত্র শীর্ষ স্তরের শিকারী। এরা বিরল এবং এদের সংখ্যা সমগ্র সিস্টেমের বাস্তুতন্ত্রের স্বাস্থ্যের প্রতিফলন। অর্থাৎ এই প্রজাতির সংখ্যা বাড়লে তা ইঙ্গিত করে যে বাস্তুতন্ত্র ভাল অবস্থায় রয়েছে।’
প্রসঙ্গত, সব ধরনের মাছ ধরা বন্ধ করার এই ধারণার কথা প্রথম বলেছিলেন ‘চাইনিজ একাদেমি অফ সায়েন্সেস’-এর অধ্যাপক কাও ওয়েনজুয়ান। সেটা ছিল ২০০৬ সাল। এরপর ১০ বছরের নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হওয়ার জন্য অন্যান্য বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে চাপ আসতে থাকে। শেষপর্যন্ত প্রায় পাঁচ বছর আগে এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়।
এই বিষয়ে নিয়মকানুন বেশ কড়া। ইয়াংসি নদী ছাড়াও সংলগ্ন হ্রদ ও উপনদীগুলোতে মাছ ধরতে গিয়ে ধরা পড়লে কারাদণ্ড হতে পারে বলে পুলিশ জানিয়েছে। তবে এই নিষেধাজ্ঞার কারণে সমস্যাও দেখা গিয়েছে। দুই লাখ লাখ কুড়ি হাজার মৎস্যজীবী এর ফলে কর্মসংস্থান হারিয়েছেন।
কিন্তু তা সত্ত্বেও পাখনাবিহীন পর্পয়েজ আজও সমালোচনামূলকভাবে বিপন্ন। এরা পর্পয়েজ পরিবারের প্রাচীনতম শাখার অংশ, যারা এখনো জীবিত রয়েছে।
বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, মানুষের সান্নিধ্যে পাখনাবিহীন পর্পয়েজ উত্তেজিত হয়ে ওঠে। লক্ষ্য করলে অবশ্য তেমনটাই দেখা যায়।
কাচে মোড়া জলাধারের অন্যপ্রান্তে মানুষ দেখলেই তারা জলের মধ্যে দিয়ে তীব্র গতিতে সাঁতার কাটতে থাকে। কাচের একেবারে গা ঘেঁষে সাঁতরায়। জলের মধ্যে দিয়ে সাঁতরে যাওয়ার সময় এমনভাবে তাকায়, যেন আপনাকে দেখে দুষ্টু হাসি হাসছে।
বন্য পরিবেশে থাকা পর্পয়েজরা এখনো টিকে আছে। অন্যান্য প্রজাতির অনেকেই যা পারেনি।
প্রসঙ্গত, ২০০৬ সালে থ্রি জর্জেস বাঁধের মূল অংশ নির্মাণ পাখনাবিহীন পর্পয়েজকে সরাসরি প্রভাবিত করেনি। অন্যান্য মাছের মতো তাদের প্রজননের সময় ডিম দিতে উজানে যেতে হয় না। তবে যে মাছগুলো তাদের খাদ্য ছিল, তার উপর ওই বাঁধ নির্মাণের অবশ্যই প্রভাব পড়েছে।
অন্যান্য বৃহৎ সামুদ্রিক প্রাণী, যেমন প্যাডেল ফিশ বা চাইনিজ স্টার্জনের জন্য, এই বাঁধের কাঠামো ছিল বিপর্যয়কর।
‘ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচার’-এর সদস্য ওয়াং ডিং ফিনলেস পর্পয়েজের মতো সিটাসিয়ানদের বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। সিটাসিয়ান হলো জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণীদের একটা শ্রেণিবিন্যাস যার মধ্যে তিমি, ডলফিন এবং পর্পয়েজও রয়েছে।
ওয়াং ডিং এই জাতীয় বাঁধ নির্মাণের ভাল এবং মন্দ, দু’টো বিষয়ই পর্যবেক্ষণ করেছেন।
অতীতের পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘প্রতিবার বন্যার মৌসুমে আমাদের মজবুত দল গঠন করতে হতো যেখানে শক্তিশালী পেশীবহুল ব্যক্তিরা থাকতেন। অনেক পুরুষ একসঙ্গে নদীর তীরে ঘুমাতেন এই আশঙ্কায় যে যদি বন্যা হয়।’
‘তারপর বন্যা হলে সবাই যথাসাধ্য চেষ্টা করতেন যাতে, বিপুল জলরাশি সবকিছু তছনছ না করে দেয়।’
থ্রি জর্জেস বাঁধ সেই বন্যার আশঙ্কা থেকে মুক্তি দিয়েছে। তবে অধ্যাপক ওয়াং শি উল্লেখ করেছেন, এই বিশাল বাঁধ ইয়াংসি নদীর বাসিন্দা বৃহৎ স্টার্জনদের তাদের প্রজনন ক্ষেত্রে পৌঁছাতে বাধা দেয়।
তিনি জানিয়েছেন, বিপন্ন প্রজাতির ওই মাছ অল্প সময়ের জন্য বিকল্প জায়গা খুঁজে পেয়েছিল বলে মনে হলেও, এখন পরিস্থিতি বদলেছে। শুধু তাই নয়, আজকাল একমাত্র নদীতেই স্টার্জন মাছ পাওয়া যায় তার কারণ গবেষকরা প্রতিবার ১০,০০০ মাছ নদীতে ছেড়ে দিচ্ছেন।
গত বছর ইয়াংসিতে দশ লাখেরও বেশি স্টার্জন মাছকে অন্যত্র রেখে প্রজনন ঘটানোর পর তাদের নদীতে ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই প্রজাতির সংখ্যা বৃদ্ধির সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। কারণ মাছগুলো বন্য পরিবেশে নিজেরাই প্রজনন করছে না।
পাখনা-বিহীন পর্পয়েজেরও যাতে একই পরিণতি না হয় তা নিশ্চিত করতে লড়াই চালাচ্ছেন অধ্যাপক ওয়াং শি এবং অন্যান্য বিজ্ঞানীরা। তারা আশা করছেন ১০ বছর মাছ ধরায় যে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে, তার মেয়াদ শেষের পরেও সেটি জারি থাকবে।
চাইনিজ একাডেমি অফ সায়েন্সেসের বুলেটিনে প্রকাশিত তাদের গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, মাছ ধরা সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হওয়ার পর থেকে পর্পয়েজের সংখ্যায় ব্যাপক বৃদ্ধি হয়েছে।
তবে, ফিনলেস পর্পয়েজের জন্য ঝুঁকি সৃষ্টিকারী অন্য একটা বিষয়ের সমাধান কঠিন হতে পারে। সেটা হলো জাহাজ চলাচলের ফলে তৈরি শব্দ।
অধ্যাপক ওয়াং শি উল্লেখ করেছেন যে ‘আওয়াজের কারণে এই সমস্ত প্রাণীর মস্তিষ্কের জন্য জাহাজ খুবই বিপজ্জনক।’
তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, জাহাজ চলাচলের সময় জলে এক ধরনের শব্দ দূষণ হয় যা জলজ প্রাণীর জন্য কষ্টদায়ক।
চীনা বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে, জাহাজের শব্দ ইয়াংসিতে বসবাসকারী বাইজি রিভার ডলফিনের মৃত্যুর কারণ হতে পারে, যেগুলো জলের নিচে যোগাযোগের জন্য সোনারের মতো পদ্ধতি ব্যবহার করত।
কিন্তু মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা এক জিনিস আর ব্যস্ত নদীতে নৌচলাচল সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেওয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। এর মাধ্যমে যাত্রীদের পাশাপাশি পণ্য পরিবহন হয় এবং মধ্য চীনের অর্থনীতির বেশিরভাগ অংশের জন্য প্রাণ জোগায়।
তবে রাসায়নিক পদার্থ উৎপাদনকারী কারখানাগুলোকে ইয়াংসি নদীর পাশ থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার পদক্ষেপটা অবশ্য সম্ভব হয়েছে।
গত দশকে হাজার হাজার কারখানা বন্ধ হয়েছে বা সেগুলো নদীর নিকটবর্তী এলাকা থেকে অন্যত্র স্থানান্তরিত করা হয়েছে। এর ফলে নদীর জলের গুণমান উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত করেছে বলে জানা গেছে।
পর্পয়েজ সংরক্ষণের প্রচেষ্টায় স্থানীয় সম্প্রদায়ের অবদানও উল্লেখযোগ্য। স্থানীয় বাসিন্দা ইয়াং হে অবসর গ্রহণের পর অপেশাদার ফটোগ্রাফি শুরু করেন। তিনি প্রতিদিনই তার ক্যামেরা এবং অন্যান্য সরঞ্জাম নিয়ে নদীতে যান এই প্রাণীগুলোকে পর্যবেক্ষণ করতে।
ভাল ছবি পেলে বিজ্ঞানীদের কাছে সেগুলো পাঠিয়ে দেন। এইভাবে তাদের ট্র্যাক করার কাজও গতি পায়।
ইয়াং হে জানিয়েছেন, একবার তিনি একটা পর্পয়েজকে মাছ ধরার জালে আটকে পড়তে দেখেছিলেন। দ্রুত স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে এই বিষয়ে জানান তিনি। উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত নদীর ওই অংশে সমস্ত জাহাজ চলাচল বন্ধ করে দেয় স্থানীয় কর্তৃপক্ষ। দেখা যায়, ওই পর্পয়েজটা গর্ভবতী ছিল। ঘটনাটা মন ছুঁয়ে গিয়েছিল তার।
১৯৯০-এর দশকে বন্য অঞ্চলে ৩৩০০টা ফিনলেস পর্পয়েজ ছিল। ২০০৬ সালের মধ্যে তা অর্ধেক হয়ে যায়।
তারপর মাছ ধরার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়, কারখানাগুলো নদীর কাছ থেকে অন্যত্র স্থানান্তরিত হয় এবং পর্পয়েজের সংখ্যা কমা বন্ধ হয়। শুধু তাই নয়, গত পাঁচ বছরের তথ্য অনুযায়ী পর্পয়েজের সংখ্যা প্রায় এক-চতুর্থাংশ বেড়েছে।
এই সংখ্যা বিজ্ঞানীদের গর্বের বিষয় হয়ে উঠেছে। সমগ্র বিষয়টা পরিবেশের উপর বিস্তৃত প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন তারা।
ওয়াং ডিংর কথায়, ‘আমরা ফিনলেস পর্পয়েজ সংরক্ষণ করছি ইয়াংসি নদীকে বাঁচাতে। এটা একেবারে আয়নার মতো কাজ করে এবং বাস্তুতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্য আমরা কতটা কাজ করছি তার একটা ধারণা দেয়।’
‘যদি পর্পয়েজরা ভালো থাকে, যদি তাদের সংখ্যা বাড়ে তাহলে এর অর্থ হলো, সমগ্র নদীর পরিবেশগত স্বাস্থ্যেরও উন্নতি হচ্ছে।’
বিডি-প্রতিদিন/বাজিত