ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া এবং তার স্ত্রী ও তিন ছেলে-মেয়ের ‘হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের’ অনুসন্ধান করতে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) আরও একটি অভিযোগ জমা পড়েছে।
ঢাকার সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে বৃহস্পতিবার জমা পড়া ১৪ পৃষ্ঠার ওই অভিযোগে আছাদুজ্জামান ও তার পরিবারের সদস্যদের অবৈধ সম্পদের ফিরিস্থি সবিস্তারে তুলে ধরা হয়েছে।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, আছাদুজ্জামানের নানা দুর্নীতির ফিরিস্তি তুলে ধরে গত জুন মাসেও একটি অভিযোগ জমা পড়েছিল। আছাদুজ্জামান পরিবারের বিপুল সম্পদ নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করতে সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটিকে চিঠিও দিয়েছিল।
ডিএমপির সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামানের অবৈধ সম্পদের বিষয় আলোচনায় আসে গণমাধ্যমে একের পর এক প্রতিবেদন প্রকাশের পর। গত ১৬ জুন দৈনিক মানবজমিন পত্রিকায় ‘মিয়া সাহেবের যত সম্পদ’ নামে খবর প্রকাশের পর প্রথম আলোসহ বিভিন্ন দৈনিকও পুলিশের সাবেক এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিপুল সম্পদ নিয়ে প্রতিবেদন করে।
অভিযোগ রয়েছে, একাধিক জাতীয় দৈনিকের পাতাজুড়ে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পরও আছাদুজ্জামানের বিষয়ে অনুসন্ধানের জন্য দুদক কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। ক্ষমতার পালাবদলের মধ্যে এবার আওয়ামী লীগ সরকার ঘনিষ্ঠ আছাদের দুর্নীতির অভিযোগ জমা পড়ল দুদকে। তবে এ বিষয়ে দুদকের আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
অভিযোগে বলা হয়েছে, আছাদুজ্জামান ও তার স্ত্রী, ছেলে-মেয়েদের নামে ঢাকাসহ দেশে-বিদেশে সম্পদের পাহাড়। স্ত্রী আফরোজা জামানের নামে ঢাকায় একটি বাড়ি ও দু’টি ফ্ল্যাট এবং মেয়ের নামে একটি ফ্ল্যাট রয়েছে।
এছাড়া ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে আছাদের স্ত্রী ও সন্তানদের নামে কয়েকশ’ শতক জমি রয়েছে। তার স্ত্রীর কোনো আয় না থাকলেও পরিবহন ব্যবসা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ব্যবসায় বিনিয়োগ রয়েছে।
আছাদুজ্জামানের সম্পদের অনুসন্ধান চেয়ে গত জুনে দুদকে চিঠি দেওয়া সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী সালাহউদ্দিন রিগ্যান বলেন, পত্রপত্রিকায় যেসব রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে তা অনুসন্ধান করে জনগণকে জানানো দুদকের দায়িত্ব। অনুসন্ধান হলেই আছাদুজ্জামান মিয়ার সম্পদের প্রকৃত সত্যতা বেরিয়ে আসবে। দুদকের উচিত শিগগির এই অনুসন্ধান কাজ শুরু করা।’
দুদকে জমা হওয়া অভিযোগে যা বলা হয়েছে
আছাদুজ্জামান নিজ নামে, স্ত্রী আফরোজা জামান ও তিন সন্তান আসিফ শাহাদাত, আয়েশা সিদ্দিকা, আসিফ মাহাদীন এবং শ্যালক-শ্যালিকা, ভাগনেসহ আরও অনেকের নামে-বেনামে হাজার-হাজার কোটি অপরাধলব্ধ সম্পদ গড়েছেন।
আছাদুজ্জামান পরিবারের অঢেল সম্পদের মধ্যে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, ভাঙ্গা হাইওয়ের পাশে এবং রাজধানীর একটি আবাসিক এলাকাসহ আফতাবনগর, মোহাম্মদপুর, জোয়ার সাহারা, সাভার ও পূর্বাচলে জমি, প্লট ও বাড়ির ছড়াছড়ি।
অভিযোগে সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান চাকরিকালে কত টাকা বৈধ উপার্জন করেছেন প্রশ্ন তুলে সেই হিসাবও তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখানো হয়, তিনি বেতন-ভাতা বাবদ সাকল্যে মোট আয় করেছেন প্রায় দুই কোটি টাকা। এর বাইরে পদবি অনুযায়ী পেয়েছেন আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা।
অথচ বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক আছাদুজ্জামান পরিবারের দেশে-বিদেশে হাজার কোটি টাকার স্থাবর সম্পত্তি। অর্থাৎ, এসব জমি, প্লট, ফ্ল্যাট, ব্যবসা অপরাধলব্ধ আয়ে গড়া।
অভিযোগে বলা হয়েছে, আছাদুজ্জামান মিয়ার নামে সাড়ে ৭ কাঠা, আফতাবনগরে ৬ কাঠা, পুলিশ হাউজিংয়ে ৬ দশমিক ৯ কাঠা, পূর্বাচল ১৪ নম্বর সেক্টরে ৩ কাঠা, পূর্বাচল ৮ নম্বর সেক্টরের ১০৮ নম্বর রোডে ৫ কাঠা ও সাভারে ২ হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট রয়েছে।
এছাড়া আছাদুজ্জামানের নামে রয়েছে ৩২২ শতাংশ জমি, ৬৮ ও ২১৫ শতাংশ জমি, ৪৯ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ৮ শতাংশ জমি আছে। এছাড়া ফরিদপুরের গ্রামে আছে বিপুল পরিমাণ কৃষিজমি।
আছাদের বড় ছেলে আসিফ শাহাদাতের বয়স ৩৫ বছর। যিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। মেয়ে আয়েশা সিদ্দিকার বয়স ৩১ বছর। ২১ বছর বয়সী ছোট ছেলে আসিফ মাহাদীন আমেরিকায় পড়াশুনা করেন। এই তিন ভাই-বোন এই অল্প বয়সেই শতকোটি টাকার সম্পদ-সম্পত্তির মালিক হয়েছেন।
স্ত্রী আফরোজা জামানের নামে রয়েছে আবাসিক এলাকায় ১০ কাঠা জমির ওপর ছয়তলা বিশিষ্ট আলিশান বিশাল বাড়ি, যার বাজার মূল্য ৫০ কোটি টাকার বেশি। এছাড়া তার নামে রাজধানীর ১৩/এ, ইস্কাটন গার্ডেন ও ধানমন্ডির ১২/এ সড়কের ৬৯ নম্বর বাড়িতে (বি/২/৫) ফ্ল্যাট আছে।
অভিজাত ধানমন্ডি-১২/এ-তে, ইস্কাটনে আছাদুজ্জামানের স্ত্রী আফরোজা জামানের নামে ফ্ল্যাট রয়েছে। পূর্বাচলে ১০ কাঠা প্লট, মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান এলাকায় প্লট রয়েছে তার।
আছাদুজ্জামানের স্ত্রী আফরোজা জামান পুরোদস্তুর গৃহিনী। তার নিজস্ব কোনো আয়ের সংস্থান নেই। তবে সম্পদে পিছিয়ে নেই। রাজধানীর অভিজাত এলাকায় একাধিক দামি ফ্ল্যাট, প্লট, ৫০ কোটি টাকা দামের আলিশান বাড়ি এবং গাজীপুরের কালীগঞ্জে ও নারায়ণগঞ্জে কোটি-কোটি টাকা মূল্যের বিপুল পরিমাণ জমি রয়েছে তার নামে।
আফেরোজার নামে রাজধানীর ধানমন্ডির ১২/এ-তে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট আছে। আরেক দামি এলাকা ইস্কাটনেও ফ্ল্যাট আছে তার। অপর একটি আবাসিক এলাকায় ১০ কাঠা জমির ওপর ৬ তলবিশিষ্ট বিশাল বাড়িও রয়েছে।
গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার চাঁদখোলা মৌজায় আফরোজা জামানের নামে ৪১ শতাংশ জমি রয়েছে। একই মৌজায় তার নামে রয়েছে আরও ২৬ শতাংশ জমি। একই মৌজায় তার নামে ২০১৯ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি কেনা হয় আরও ৩৯ শতাংশ জমি। এছাড়া জোয়ার সাহারা মৌজায় ৫ কাঠা জমি, একই মৌজায় আরও ১০ কাঠা জমি, একই মৌজায় আরও ৩৯ শতক জমি রয়েছে তার। এছাড়াও আফরোজা নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কৈয়ামসাইর-কায়েতপাড়া মৌজায় দশমিক ২৮ একর, একই মৌজায় আরও ৩২ শতক জমির মালিক।
ঢাকার বাইরে গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে আফরোজা জামানের যে বিপুল পরিমাণ জমি কেবল সেগুলির বর্তমান বাজারমূল্যই শত-শত কোটি টাকা। অথচ, তার মতো একজন গৃহিনীর পক্ষে এত জমি কেনা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
এছাড়া শেপিয়ার্ড কনসোর্টিয়াম লিমিটেড নামের আরেকটি কোম্পানির চেয়ারম্যান আফরোজা জামান। অথচ তিনি একজন আগাগোড়া গৃহবধূ, যার কোনো নিজস্ব পেশা ছিল না। এই কোম্পানির পরিচালক আছাদুজ্জামানের বড় ছেলে আসিফ শাহাদাত।
মেয়ে আয়েশা সিদ্দিকার নামে রাজধানীর ৫৬/৫৭, সিদ্ধেশ্বরী রোডে রূপায়ন স্বপ্ন নিলয় ৩ নম্বর বিল্ডিংয়ে ৪ হাজার বর্গফুট আয়তনের ফ্ল্যাট আছে। এছাড়া তার নামে মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান এলাকায় প্লট আছে। ২০২১ সালে বিপুল পরিমাণ কালোটাকা সাদাও করেছেন তিনি, যখন তার বয়স ছিল মাত্র ২৮ বছর।
ছোট ছেলে আসিফ মাহাদিনের নামে নিকুঞ্জ আবাসিক এলাকার ৮/এ রোডের ৬ নম্বর ট্রিপ্লেক্স বৈশিষ্টের বাড়িটি তার নামে। এটির বাজারমূল্য ১০ কোটি টাকার বেশি। এছাড়া আফতাবনগরেও তার নামে ৫ কাঠা প্লট আছে।
এছাড়া আছাদুজ্জামান মিয়া গাজীপুরের শ্রীপুরে দেড় একর জমির মালিক। ভাগ্নে ইব্রাহিম শেখ ওরফে কলম ও শ্যালক নূর আলম ওরফে মিলনের নামে কেনা হলেও তারা কার্যত বেকার অর্থাৎ তাদের কোনো আয় নেই।
অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, আছাদুজ্জামানের শ্যালক-শ্যালিকার নামেও সম্পত্তির ছড়াছড়ি। তাদের নামেও কোটি কোটি টাকার জমি রয়েছে। শ্যালিকা ফাতেমাতুজ্জোহরার নামে ধানমন্ডিতে ফ্ল্যাট, খুলনায় বাড়ি এবং মোহাম্মদপুরে একাধিক জমি রয়েছে। পরিবহন ব্যবসাও রয়েছে তার।
আছাদুজ্জামানের স্ত্রীর সৎ ভাই হারিচুর রহমান সোহানের নামেও পরিবহন ব্যবসা আছে। এছাড়া তিনি নিজেকে পিওর গোল্ড লিমিটেডের ভাইস চেয়ারম্যান পরিচয় দিয়েছেন। শ্যালকের এসব ব্যবসায় আছাদুজ্জামানই বিনিয়োগকারী বলে অভিযোগে বলা হয়েছে।
সোহানের নামে রাজধানীর অভিজাত বেইলি রোড, শাহজাহানপুরে ফ্ল্যাট রয়েছে। বনশ্রী ও আফতাবনগরে একাধিক প্লট রয়েছে। এর মধ্যে বনশ্রীর একটি প্লটে বাড়ির নির্মাণকাজও চলছে। আছাদুজ্জামান মিয়ার অবৈধ টাকা দিয়ে এসব সম্পদ গড়া হয়েছে।
এছাড়া চলতি বছরের ১৫ মে ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা পৌরসভায় তারা মিয়া নামে এক ব্যবসায়ীর ছেলের কাছ থেকে ৩০ শতাংশ জমি কেনা হয়েছে সোহানের নামে। ৩ কোটি টাকা দিয়ে ওই জমি মূলত আছাদুজ্জামানই কিনেছেন শ্যালক সোহানের নামে।
তবে আছাদুজ্জামানের বাবার সুনির্দষ্ট কোনো পেশা ছিল না। তবে গ্রামে সামান্য কিছু জমিজমা ছিল। সেসব দিয়ে তাদের পরিবারের জীবিকা নির্বাহ হতো। অর্থাৎ, বিপুল পরিমাণ জমিজমার মালিক বা অর্থ-বিত্তশালী অবস্থা তাদের ছিল না।
আছাদুজ্জামান মিয়া ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ডিএমপি কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে তাকে জাতীয় নিরাপত্তাসংক্রান্ত সেলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদে নিয়োগ দেয় সরকার। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে তার চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়।
অভিযোগ রয়েছে, ডিএমপি ছেড়ে গেলেও সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান এখনো সেখানকার স্টিকারযুক্ত গাড়ি ব্যবহার করেন। গেল সংসদ নির্বাচনে তিনি তার পূর্বের পেশাগত পরিচয় খাটিয়ে প্রভাব বিস্তার করেন, যা সেসময় গণমাধ্যমে খবর হয়।