দেশের অর্থনীতির শিরায় রক্ত জোগায় যে শিল্প, সে-ই আজ নিঃস্ব। উৎসবের ঢাক বাজছে বাজেটের নামে অথচ ধ্বংসের ঘণ্টা বাজছে কারখানাগুলোয়। গ্যাস নেই, বিদ্যুৎ নেই, ঋণ নেই। উদ্যোক্তা আছেন কিন্তু প্রাণ নেই। চারপাশে থমথমে নীরবতা- চোখ খুলুন, শিল্পকারখানা মরছে! ঋণ নেই, গ্যাস নেই, মালিক নেই শিল্প কীসে বাঁচবে? শিল্পে দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। উৎপাদন কমছে, কারখানা বন্ধ হচ্ছে, শ্রমিক ঘরে ফিরছে। অথচ বাজেট আসছে-উৎসবের ঢাক বাজছে। প্রশ্ন একটাই-এবারও কি কাগজকলমে ‘শিল্পের উন্নয়ন’ হবে আর বাস্তবে শিল্পের কফিনে আরেকটা পেরেক ঠোকা হবে? প্লিজ এবার বাজেট শিল্পবান্ধব করুন। শিল্পমালিকদের নির্বিঘ্নে শিল্পকারখানা চালাতে দিন। রাষ্ট্র পরিচালকদের উদ্দেশে বলছি, শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ব্যথা বুঝুন, বন্ধ হলে কুফল কী সেটা বুঝুন।
খবর নিন, একটার পর একটা কলকারখানার দ্বার বন্ধ হচ্ছে। মেশিনের শব্দ থেমে গেছে, ধোঁয়া ওঠা চিমনিগুলো এখন কেবল স্মৃতি। হাজারো শ্রমিক ফেরত যাচ্ছে শূন্য হাতে, ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা বুকে নিয়ে। অথচ বাজেট আসছে উৎসবের মুখোশ পরে। সংবাদ সম্মেলনে হাসিমুখ, রিপোর্টে উন্নয়নের বর্ণমালা। কিন্তু বাস্তবে শিল্পের শবযাত্রা চলছে নিঃশব্দে।
প্রশ্ন একটাই- এ বাজেটেও কি ‘শিল্প উন্নয়ন’ হবে শুধু ফাইলের পাতায়? আর বাস্তবে চলবে অব্যাহত অবহেলা, উদাসীনতা, আরেকটি পেরেক ঠুকে দেওয়া হবে দেশের উৎপাদনব্যবস্থার কফিনে? রাষ্ট্র পরিচালকদের কাছে নিবেদন-দয়া করে এবার শিল্পের কান্না শুনুন। মুখে ‘রপ্তানি’ বলবেন, অথচ উদ্যোক্তারা গ্যাসের জন্য ধরনা দেবেন- এ দ্বিচারিতা চলতে পারে না। শিল্প নেই মানে কর্মসংস্থান নেই, বৈদেশিক আয় নেই, নেই আত্মনির্ভরতার ভিত্তি। শিল্পকে বাঁচতে দিন, চলতে দিন। এ দেশকে বাঁচাতে হলে আগে শিল্পকে বাঁচান।
এ দেশের শিল্পপতিরা আজ আতঙ্কে দিন গুনছেন। তারা চোর নন, ডাকাত নন, কর ফাঁকি দেওয়া লোকও নন। বরং দিনের পর দিন ব্যাংকের দুয়ারে ধরনা দিয়ে, গ্যাস-বিদ্যুৎ ছাড়া আধা-অন্ধকারে কাজ চালিয়ে যারা দেশের অর্থনীতিকে জাগিয়ে রেখেছেন, তারাই এখন সবচেয়ে বেশি অবজ্ঞার পাত্র। রাষ্ট্রের কাছে তারা যেন এক ঝামেলার নাম! কারখানায় উৎপাদন চলছে ৪০-৫০ শতাংশ। অথচ ব্যাংক বলছে, ‘ঋণের কিস্তি সময়মতো না দিলে খেলাপি বানাব।’ সরকার বলছে, ‘শ্রমিকের বেতন সময়ে দাও, না হলে শাস্তি পাবে।’ এ যেন বস্তাবন্দি করে নদীতে ফেলে সাঁতার কাটতে বলার মতো। কেউ জিজ্ঞেস করছে না, ‘এই লোকটা বাঁচছে কীভাবে?’ শিল্পপতিরা না বাঁচলে শিল্প বাঁচবে কী করে। শিল্প পরিচালনার জন্য অনেক মেধার প্রয়োজন হয়। ড্রাইভিং সিটে বসে শিল্প চালান শিল্পপতিরা। তাদের হাত-পা বেঁধে রাখলে চলবে না। কেউ অপরাধী থাকতে পারেন, তাই বলে শিল্পকারখানা বন্ধ করা যাবে না। প্রতিষ্ঠানটি চলার ব্যবস্থা করতে হবে। নইলে শ্রমিক বেকার হবে, দেশের অর্থনীতিতে তার বিরাট প্রভাব পড়বে।
আমরা এমন এক সময়ে দাঁড়িয়ে আছি যেখানে শিল্পমালিক, শ্রমিক, উদ্যোক্তা- সবার চোখে আজ হতাশা। কেউ বলছে গ্যাস নেই, কেউ বলছে বিদ্যুৎ নেই, কেউ বলছে ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়া যায় না। আর সরকার? সরকার বলছে, ‘বেতন ঠিক সময়ে দাও, না হলে আইন আছে!’ আমার প্রশ্ন, এ রাষ্ট্র কি শুধু আইন জানে? ন্যায় জানে না? আমার নানা এখলাস গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের কর্ণধার হাজি এখলাস উদ্দিন ভুইয়া বলতেন, ‘দেশটা গরিব হতে পারে, কিন্তু মানুষের স্বপ্নটা গরিব হলে চলে না।’ আজ শিল্পপতিরা স্বপ্ন দেখতে ভুলে যাচ্ছেন। ব্যাংককে, সরকারকে, সমাজকে- সবার উচিত তাদের পাশে দাঁড়ানো। কারণ শিল্প বাঁচলে মানুষ বাঁচবে, সমাজ বাঁচবে, রাষ্ট্রও বাঁচবে।
আমাদের দেশের শিল্পপতিরা কেউ অন্য গ্রহ থেকে আসেননি। এরা এ দেশের সন্তান। এ মাটির ঘামে, পরিশ্রমে, ঘর বন্ধক রেখে কারখানা বানিয়েছেন। অথচ আজ রাষ্ট্র তার দায়িত্ব ভুলে গেছে। শুধু ঋণ আদায়ের খাতা আর হিসাবের কষাকষিতে শিল্প ধ্বংসের পথে। আমি বহু দেশ ঘুরেছি, বহু শিল্পনগরী দেখেছি, কিন্তু এমন নিষ্ঠুর বাস্তবতা খুব কম জায়গায়ই দেখেছি। সেখানে সরকার শিল্পকে ঘিরে পরিকল্পনা করে, প্রণোদনা দেয়, সহযোগিতা করে। আমাদের দেশে সরকার শুধু দাবি করে- দাও, জমাও, হিসাব দাও। প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা শিল্প চাই, না দুর্ভিক্ষ? শিল্প যদি মরে যায় তাহলে কয়েক বছর পর হুট করে আমরা দেখব, বেকারত্ব বেড়েছে, মুদ্রাস্ফীতি আকাশছোঁয়া, সামাজিক অপরাধ ছড়িয়ে পড়ছে। তখন বাজেট দিয়ে আর কিছু রক্ষা করা যাবে না। এখনো সময় আছে।
এ অবস্থায় আমরা কোন অর্থনীতি চাই? আমরা চাই একটি টেকসই অর্থনীতি, যেখানে কাঁচামাল আমদানিতে অগ্রাধিকার থাকবে, গ্যাস-বিদ্যুৎ শিল্প খাতের জন্য নিরবচ্ছিন্ন থাকবে, ব্যাংক লোন সহজ হবে, আমলাতন্ত্র কমবে। শিল্পপতিরা ভিলেন নয়, তারা সুযোগ পেলে সমাজের নায়ক হতে পারেন। শিল্পকে দমন নয়, সহানুভূতি দিয়ে বাঁচান। একটি শিল্প বন্ধ মানে কয়েক হাজার মানুষের জীবিকা বন্ধ। একটি শিল্প রুগ্ণ মানে একটি এলাকার অর্থনীতি রগ্ণ। অথচ আমরা দেখি, যেই মালিক সমস্যায় পড়ে, তাকে নানা অনুসন্ধান, হয়রানি ও হুমকির মধ্যে ফেলা হয়। আমি বলছি, অপরাধী হলে বিচার হোক, কিন্তু তার শিল্প যেন মরে না যায়।
শিল্প বাঁচানো মানে শুধু অর্থনীতিকে বাঁচানো নয়, এটা মানবিক দায়িত্ব। গার্মেন্ট হোক বা টেক্সটাইল, ওষুধ হোক বা রপ্তানি শিল্প, সবখানে শ্রমিকের রক্ত-ঘাম মিশে থাকে। এদের সুরক্ষা মানেই রাষ্ট্রের প্রাণ ফিরিয়ে আনা। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট হতে হবে শিল্পবান্ধব, এই হোক অঙ্গীকার। এ বাজেট যেন হয় কর্মসংস্থানের ভিত্তি, উদ্যোক্তাদের আশ্রয়, ব্যাংক-শিল্প সংলাপের সেতু। করের বোঝা নয়, হোক সহায়তার হাত। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার ভিড়ে নয়, হোক সহজ প্রক্রিয়া।
এটা কি আমরা ভুলে গেছি যে শিল্প মানেই কর্মসংস্থান? শিল্প মানেই একেকটা পরিবারের রুটি রুজির নিশ্চয়তা? ‘চোরেরা সব চুরি করে গেছে’, কারা চোর? সবাই জানে। টেক্সটাইল ও গার্মেন্ট খাতের নেতারা সরাসরি বলেছেন, ব্যাংকিং খাতের অবস্থা ভয়াবহ। চোরের দল সবকিছু লুটেপুটে খেয়ে গেছে। এখন সেই দায় চাপানো হচ্ছে শিল্পমালিকদের কাঁধে। ব্যাংক লোন পাওয়া যাচ্ছে না। সুদের হার উঠেছে ১৪-১৬ শতাংশে। গ্যাস চাইলেও পাওয়া যাচ্ছে না, আর বিদ্যুৎ গেলে আসে ভ্যাঙচি মেরে। এমন শিল্পনীতি নিয়ে কোন উন্নয়ন? গুটি কয়েক ব্যাংকচোর সব লুট করে গেছে। তাতে শিল্প পড়েছে বেকায়দায়। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘাঁয়ের মতো শিল্পমালিকদের নানাভাবে চাপে রাখা হচ্ছে। তাতে শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। যেগুলো চলছে তা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।
বাজেট হোক শিল্পবান্ধব? সরকার বলছে, ‘এবার বাজেট হবে উৎপাদনমুখী, বিনিয়োগবান্ধব।’ বাস্তবে সেটা হয় কি না, দেখা যাক। এ শিল্প খাতের জন্য বাজেট যদি সত্যিকারের সহানুভূতিশীল না হয় তাহলে শুধু পত্রিকার পাতায় ভাষণ ছাপিয়েই শিল্প বাঁচবে না। চাই বাস্তব পদক্ষেপ। কী পদক্ষেপ চাই- (১) শিল্প খাতে গ্যাস ও বিদ্যুতে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করুন, (২) ব্যাংকঋণের সুদের হার শিল্পবান্ধব পর্যায়ে আনুন, (৩) কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক ছাড় ও অগ্রাধিকার দিন, (৪) বন্ধ হওয়া শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করতে রিভাইভাল প্যাকেজ ঘোষণা করুন, (৫) শিল্পমালিকের ভুল থাকলে বিচার করুন, কিন্তু তার শ্রমিকের ভবিষ্যৎ কেড়ে নেবেন না, (৬) উৎপাদন খাতে প্রণোদনা দিন, ব্যবসা চালু রাখতে কর্মপরিকল্পনা নিন, (৭) উদ্যোক্তাদের সম্মান দিন, অপরাধী বানাবেন না।
এ শিল্প কার জন্য? শিল্প মানে শুধু মালিকের নয়, দেশ এবং শ্রমিকেরও। মালিক মানে শুধুই লভ্যাংশ না, তার সঙ্গে দায়িত্বও আছে। কিন্তু সেই দায়িত্ব পালন করতে হলে রাষ্ট্রকে আগে তার পাশে দাঁড়াতে হবে। আইন, কর, সুদের বোঝায় যখন একজন উদ্যোক্তা নুয়ে পড়ে তখন তার কারখানায় আলো জ্বলে না, ভবিষ্যৎ নিভে যায়। আজকের এ অব্যবস্থার মধ্যে বহু শিল্প ইতোমধ্যে বন্ধ হয়েছে। বাকিরাও দম আটকে পড়ে আছে। অথচ একটা বাজেটেই অনেক কিছু বদলে দেওয়া সম্ভব, যদি সদিচ্ছা থাকে।
বাজেট কার জন্য? উন্নয়নের গল্প শুনিয়ে লাভ নেই, যদি পেটে ভাত না থাকে। শিল্প বাঁচলে তবেই কর্মসংস্থান, রপ্তানি, রাজস্ব- সব টিকবে। আজ বাজেট শুধুই সংখ্যা নয়, এটা দেশের শিল্পকে নতুন প্রাণ দেওয়ার শেষ সুযোগ। এ সুযোগ হাতছাড়া করলে ক্ষুধা, বেকারত্ব আর দুর্ভিক্ষের দিকে ধাবিত হবে বাংলাদেশ। ইতিহাস এমন রাষ্ট্রের প্রতি করুণা করে না।
সামনের বাজেট যদি শিল্প খাতকে অগ্রাধিকার না দেয় তবে তা হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। শিল্প রক্ষা করা মানে কেবল অর্থনীতি টিকিয়ে রাখা নয়, এটি লাখো শ্রমজীবী মানুষের খাবার টিকিয়ে রাখার প্রশ্ন, একটি রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা রক্ষার শপথ। এ বাজেট হতে হবে প্রকৃত অর্থেই শিল্পবান্ধব, সহানুভূতিশীল ও সময়োপযোগী। একটি জাতির উন্নয়নের মেরুদণ্ড তার শিল্প। আর শিল্প যদি মরে যায় তাহলে রাষ্ট্রও ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যায়, শুধু কাঠামোটা বেঁচে থাকে, ভিতরটা ফাঁপা হয়ে যায়। আজ বাংলাদেশের শিল্প খাত এমনই এক ফাঁপা ভবনের নিচে দাঁড়িয়ে ধ্বংসের প্রতীক্ষায়। তাই শিল্প বাঁচান, রাষ্ট্রকে বাঁচান। সরকারের উচিত আগামী বাজেটে শিল্প খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া। কারণ শিল্পই দেশের ফুসফুস। ফুসফুস বন্ধ মানে নিঃশ্বাস থেমে যাওয়া।
লেখক : সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, মহাসচিব-কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ
www.mirabdulalim.com