বাংলাদেশ এখন এক অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে দাঁড়িয়ে। একদিকে আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে প্রশাসনিক তৎপরতা জোরদার করা হচ্ছে, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এক জটিল ও বহুমাত্রিক বাণিজ্য আলোচনার চাপে রয়েছে ঢাকা। নতুন করে আরোপিত ৩৫ শতাংশ শুল্ক এবং দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তির শর্তাবলি আমাদের অর্থনীতি, কূটনীতি ও রাজনৈতিক ভবিষ্যতের ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
শুল্ক বাড়ানোর আঘাত, অর্থনীতির জন্য ভয়াবহ বার্তা
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের প্রধান রপ্তানি বাজার। বর্তমানে যেখানে গড়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়, সেখানে নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সেটি দাঁড়াবে ৫০ শতাংশে।
গার্মেন্ট শিল্পের জন্য এটি শুধু একটা সংখ্যাগত চাপ নয়, বরং এটি এক নৈতিক ও কৌশলগত চ্যালেঞ্জ, যা দেশের লাখ লাখ পোশাকশ্রমিক, রপ্তানিকারক ও অর্থনৈতিক স্থিতির ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এ শুল্ক বাড়ানোর পেছনে কেবল অর্থনৈতিক কারণ নয়, বরং রাজনৈতিক ও কৌশলগত উদ্দেশ্যও বিদ্যমান। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন দ্বিতীয় মেয়াদের মার্কিন প্রশাসন যে এক প্রকার বাণিজ্যিক চাপপ্রয়োগের কৌশল হিসেবে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। প্রশ্ন হচ্ছে এ কৌশল মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশের প্রস্তুতি কেমন এবং তা কতটা কার্যকর?
চুক্তির ফাঁদ : অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন
ঢাকা-ওয়াশিংটন সর্বশেষ আলোচনার সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তিতে এমন কিছু বাণিজ্যিক ও নীতিগত শর্ত থাকছে, যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতার বাইরে এবং রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর। জানা গেছে, শুধু শুল্ক নয়, বরং বাণিজ্য বিধিমালা, নিষেধাজ্ঞার পরিপালন, নির্দিষ্ট দেশের সঙ্গে সম্পর্কের সীমাবদ্ধতা ইত্যাদি বিষয় আলোচনায় আছে, যা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নিয়মের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক।
এ ধরনের চুক্তি বাংলাদেশকে একধরনের আন্তর্জাতিক নীতির অনুগত রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে, যেখানে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। যেমনটি মন্তব্য করেছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) ফজলে এলাহি আকবর-এটি হতে পারে ‘নিজের হাতে হ্যান্ডকাফ পরানো’র মতো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।
নির্বাচন ও বাণিজ্য আলোচনার সময়সজ্জা : কাকতালীয় নাকি কৌশলগত?
যেখানে দেশের সার্বভৌম অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তে একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক সরকারের ভূমিকা থাকা উচিত, সেখানে বর্তমানে এ আলোচনা চালাচ্ছে একটি অন্তর্বর্তীকালীন অনির্বাচিত সরকার। আর এ নিয়েই উঠছে নৈতিক ও সাংবিধানিক প্রশ্ন-এই সরকার এ ধরনের দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার রাখে কি না?
চুক্তির শর্ত নিয়ে এখনই কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে তা ভবিষ্যতের নির্বাচিত সরকারের ওপর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বোঝা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়া হবে। এমন পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নির্বাচনকালীন প্রস্তুতির ঘোষণা ফেব্রুয়ারি কিংবা এপ্রিলের মধ্যে ভোট একদিকে স্বস্তির ইঙ্গিত দিলেও অন্যদিকে প্রশ্নও তৈরি করছে : ‘আলোচনার এ মুহূর্তে নির্বাচনের প্রস্তুতি ত্বরান্বিত করার পেছনে কি কোনো আন্তর্জাতিক চাপের ভিত্তি আছে?’
জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজন : রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে সিদ্ধান্ত
সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর মতে, ‘এটা কোনো সরকারের বিষয় না, বরং দেশের সার্বিক স্বার্থের প্রশ্ন।’ একমত রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ধরনের সংবেদনশীল ও গভীর কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে সম্পৃক্ত করে জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তোলা উচিত। বাণিজ্যিক স্বার্থ যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি রাজনৈতিক বৈধতা ছাড়া এ ধরনের চুক্তি ভবিষ্যতে রাষ্ট্রের নৈতিক ভিত্তি দুর্বল করে দেবে।
বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক স্থবিরতা
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন যথার্থই বলেছেন, ‘অর্থনীতি এখনো ঘুরে দাঁড়ায়নি, বিনিয়োগ আসছে না। এমন অনিশ্চয়তা বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করছে।’ এ প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক বাড়ানো বা কঠিন বাণিজ্য চুক্তি একেবারে মহাসংকেতের মতো। যদি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও নীতিনির্ধারণে স্বচ্ছতা না থাকে, তাহলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশ অকল্পনীয়ভাবে পিছিয়ে পড়বে।
এখনই সময় সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের
বাংলাদেশ এখন একটি জটিল কূটনৈতিক চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে। বাণিজ্য, রাজনীতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ত্রিমাত্রিক টানাপোড়েনের এ সময়ে প্রয়োজন সাহসী, স্বচ্ছ এবং দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই সিদ্ধান্ত। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি করতে হলে সেটি জনগণের ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত একটি নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমেই হওয়া উচিত। এ নীতি কেবল সাংবিধানিক নয়, রাষ্ট্রীয় স্বার্থ রক্ষারও অপরিহার্য শর্ত।
জাতীয় স্বার্থকে দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে তুলে এনে সরকার, রাজনৈতিক দল, বেসরকারি খাত ও নাগরিক সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করে এক জাতীয় কণ্ঠস্বর গড়ে তুলতে হবে। নয়তো একদিন হয়তো দেখা যাবে আমরা নিজেরাই নিজেদের শর্তে নয়, অন্যের শর্তে পথ চলছি। বাংলাদেশের স্বার্থের পক্ষে এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় কূটনৈতিক পুঁজি হলো জাতীয় ঐক্য। এ ঐক্য প্রতিষ্ঠিত না হলে অর্থনীতি, রাজনীতি ও সার্বভৌমত্ব সবই প্রশ্নের মুখে পড়বে।
লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, বাংলাদেশ প্রতিদিন