কারবালার প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচানা করতে গেলে দেখা যায়, রাষ্ট্রব্যবস্থা যখন দুর্নীতি আর অনৈতিক জীবনাচারে ডুবে গেছে, তখন ইমাম হোসাইন নিজের জীবন দিয়ে তার প্রতিবাদ করেছেন। নবীজি (সা.)-এর সময় থেকেই মুসলিম নামধারী একটা চক্র সব সময় সক্রিয় ছিল কীভাবে ইতিহাস থেকে মুহাম্মদ (সা.)-এর নামটি মুছে ফেলা যায়। তারাই খলিফা ওমর (রা.)-কে হত্যা করেছে। হত্যা করেছে উসমান ও আলীকেও। মাঝে আমিরে মুয়াবিয়া (রা.) বেশ দীর্ঘ সময় রাষ্ট্রীয় স্থিতি বজায় রাখতে কার্যকর ভূমিকা রাখেন। ইসলামি সাম্রাজ্যের বিস্তারের পাশাপাশি কোনো কোনো প্রদেশে এ সময় ঘুষ-দুর্নীতি গোপন ও প্রকাশ্যে মাথা চাড়া দিতে থাকে। প্রশাসকদের কেউ কেউ খোলাফায়ে রাশেদিনদের নীতি থেকে সরে গিয়ে বিলাস ও ভোগের জীবন বেছে নেয়। বাইতুল মালের অর্থে তারা নিজেদের ভোগ বিলাস ছাড়াও শাসনব্যবস্থা থেকে আমানত, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, পরামর্শভিত্তিক শাসনব্যবস্থা কোরআনি বিধান দ্রুত মুছে ফেলতে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে মুসলিম বিশ্বের জন্য একজন সৎ আল্লাহভীরু শাসক দরকার ছিল। যিনি দুর্নীতিবাজ ও ইসলামবিরোধী প্রশাসকদের ব্যাপারে হজরত ওমর (রা.)-এর মতো কঠোর ভূমিকা রাখবেন। কিন্তু ইতিহাসের এ বাঁকে ঘটে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা। পরবর্তী শাসক হিসেবে আবির্ভূত হন ইয়াজিদ নামের কুখ্যাত পাপিষ্ঠ ও দুরাচার ব্যক্তি। যেহেতু শাসনব্যবস্থা থেকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়ে গেছে অনেক আগেই, তাই ইয়াজিদের এ অবৈধ মনোনয়নের বিরুদ্ধে জনগণের বড় অংশই গোপনে প্রতিবাদ করেছিল। আর প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করেছেন নবীজি (সা.)-এর নাতি হোসাইন (রা.), আবু বকর (রা.)-এর ছেলে আবদুর রহমান (রা.), ওমর (রা.)-এর ছেলে আবদুল্লাহ (রা.), জোবায়ের (রা.)-এর ছেলে আবদুল্লাহ (রা.) এবং আব্বাস (রা.)-এর ছেলে আবদুল্লাহ (রা.)।
পরবর্তী সময়ে একপর্যায়ে কারবালায় ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে ইমাম হোসাইন সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান করে নির্মমভাবে শাহাদাতবরণ করেন, সে ইতিহাস কমবেশি সবার জানা। মহররম এলে শিয়া মুসলমানরা তাদের ঐতিহ্যগত বিভিন্ন রসম-রেওয়াজের মাধ্যমে কারবালার মর্মান্তিক শোকাবহ ঘটনা স্মরণ করেন। সুন্নি মুসলমানরা ওয়াজ-মাহফিল, সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের মাধ্যমে শাহাদাতে কারবালা ও হোসাইনের আত্মত্যাগের ঘটনা বলেন এবং লেখালেখি করেও বিষয়টি আলোচনায় আনেন। কারবালা ও ইমাম হোসাইনের আত্মত্যাগ স্মরণীয়, বরণীয় এবং অবিস্মরণীয় সন্দেহ নেই। কিন্তু যে কারণে ইমাম জীবন দিলেন এবং ইতিহাসে ইয়াজিদ ঘৃণিত হয়ে আছে, সে কারণ কি আমরা ধারণ করতে পেরেছি? ইমাম ছিলেন সত্যের প্রতীক। আর ইয়াজিদ ছিল মিথ্যার প্রতিবিম্ব। রাষ্ট্রীয় অনাচার-দুর্নীতির বিরুদ্ধে ইমামের অবস্থানের কারণে তিনি আজ আমাদের কাছে বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে আছেন। অন্যদিকে লোভলালসা-মদ-ক্ষমতা আর নারীলোলুপতার জন্য ইয়াজিদ বিশেষভাবে ঘৃণিত। নিজেকে প্রসন্ন করার সময় এসেছে, আমরা যে হোসাইন (রা.)-এর জন্য কাঁদি, তাঁকে আমাদের আদর্শ বলে স্বীকার করে নিয়েছি, এর বাস্তবতা আমাদের জীবনে কতটুকু? আজকের বাংলাদেশের দিকে তাকালে হাতে গোনা কয়েকজন হয়তো হোসাইনি রঙের মানুষ পাওয়া যাবে। বাকি সবাই আমরা ইয়াজিদের কালো-কুৎসিত চরিত্রের অধিকারী নোংরা মানুষই রয়ে গেলাম। যেসব কারণে আমরা ইয়াজিদকে ঘৃণা করি, সব কারণই আমাদের মধ্যে রয়েছে। ইয়াজিদের মস্ত বড় দোষ ছিল ক্ষমতার লোভ। আজকের বাংলাদেশের দিকে তাকালে স্পষ্টই বোঝা যায় ক্ষমতার জন্য মানুষ কতটা মরিয়া। ইউনিয়ন পর্যায় থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে ক্ষমতালোভী ইয়াজিদরা আজ চক্রান্তের জাল বিছিয়ে রেখেছে। ইয়াজিদের দ্বিতীয় লোভ ছিল অর্থের। অর্থ হলো ক্ষমতার বাই প্রোডাক্ট। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যার ক্ষমতা আছে তার অ্যাকাউন্টে অটোমেটিক অর্থ ঢুকতে থাকে। একসময় দেশের ব্যাংকগুলোতে তার টাকা রাখার জায়গা হয় না। সুইস ব্যাংকসহ বিদেশের ব্যাংকে তার টাকা বাড়তে থাকে। পৃথিবীর ইতিহাসে যখনই কেউ ক্ষমতার জন্য অবৈধ পথে লড়াই করেছে, সেই ইয়াজিদের ভাই হিসেবে নিজের নাম লিখিয়ে নিয়েছে। ক্ষমতা তো লড়াই করে বা জোর করে নেওয়ার বিষয় নয়। ক্ষমতা হলো দায়িত্ব। পৃথিবীর এমন কোনো পাগল আছে যে দায়িত্বের বোঝা চেয়ে নেয়। হ্যাঁ, আল্লাহ যদি কাউকে দায়িত্ব দিয়ে দেন তাহলে তা সঠিকভাবে পালন করতে হবে। কিন্তু যোগ্যতা নেই, নৈতিক শক্তি নেই, শুধু অর্থ আর খ্যাতির লোভে ক্ষমতা দখল-এটা ইসলাম তো বটেই যে কোনো বিবেকবান মানুষের কাছেও অন্যায় প্রক্রিয়া। ক্ষমতা জোর করে দখল করার বিষয় নয় ঠিক। তবে কেউ যদি জোর করে ক্ষমতায় বসে এবং জনগণের ধর্মীয় ও মৌলিক অধিকার হরণ করে, তাহলে তার বিরুদ্ধে জিহাদ করা ফরজ। আর কেউ যদি, ওই শক্তির বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ না করে, তাহলে একা হলেও তার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে।
লেখক : প্রিন্সিপাল, সেইফ এডুকেশন ইনস্টিটিউট