ঠিক যে মুহূর্তে আমরা বিশ্বব্যাপী খাদ্যচাহিদা পূরণের সংকল্প নিয়ে ভাবছি, ঠিক সে সময়টিতে বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থিত হয়েছে এক অশনিসংকেত। সারা বিশ্বের গণমাধ্যমগুলো ফলাও করে প্রচার করছে আর ১০-১২ বছরের মধ্যে অন্তিম দশা নেমে আসবে পৃথিবীর। জাতিসংঘের জলবায়ু রিপোর্টে আশঙ্কা করা হয়েছে, পৃথিবীপৃষ্ঠের উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি তীব্র খরা, জলোচ্ছ্বাস ও ভয়াবহ বন্যার দিকে। উষ্ণায়নের এ নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে অনেক আগে থেকেই ভাবতে বসেছে উন্নত দেশগুলো। এমনকি কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনব্যবস্থার মধ্যেও আনছে নতুন নতুন পরিবর্তন। আমরা দৃষ্টি দিতে পারি উন্নত বিশ্বের কৃষি পরিকল্পনার দিকে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার বিবেচনায় ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর ৬৭ শতাংশ লোক চলে আসবে নগর এলাকায়। তাই তারা কৃষিকেই নগরে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করছে। কৃষি তো এখন শুধু মাঠের বিষয় নয়। কৃষির সম্প্রসারণ হবে ঊর্ধ্বমুখী। ২০-২২ তলা বিল্ডিংয়ের ভিতর নিয়ন্ত্রিত আলো-বাতাসে চাষ হবে সতেজ ফসলের। যেমন নেদারল্যান্ডসে টেলিকমিউনিকেশনস প্রতিষ্ঠান ফিলিপসের বাতিল করা ছয়তলা বিশাল ভবনটি হয়ে উঠেছে ইউরোপের সবচেয়ে বড় নগরকৃষির ক্ষেত্র। জাপানে নগরে বসবাসরত ২৫ ভাগ পরিবার কৃষির সঙ্গে যুক্ত। টোকিও শহরে প্রায় ৭ লাখ নাগরিকের সবজি আসে নগরকৃষি থেকে। নিউইয়র্কে প্রায় ১০০ একর জমি ব্যবহৃত হচ্ছে নগরকৃষিতে। কেনিয়ার নাইরোবিতে খাদ্য প্রতুলতার জন্য চলছে নগরকৃষি কার্যক্রম। আর জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, সারা পৃথিবীতে ৮০ কোটি লোক নগরকৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত। যারা মোট উৎপাদিত খাদ্যের ১৫-২০ শতাংশ উৎপাদন করে। নেদারল্যান্ডস নগরকৃষিতে সমৃদ্ধ বলেই ছোট্ট দেশ হয়েও নিজেদের চাহিদা পূরণ করে সারা পৃথিবীতে সম্প্রসারণ করতে পেরেছে খাদ্যপণ্যের বাণিজ্য। হংকংয়ে প্রায় ১ হাজার ৪০০ জন নগরকৃষির সঙ্গে যুক্ত। এ ছাড়া হংকংয়ে ‘রুফটপ রিপাবলিক’ নামে একটা গ্রুপ তৈরি হয়েছে, যারা পরিচালনা করছে ৩৩টি খামার। এটিই আজকের পৃথিবীর বাস্তবতা। কৃষিকে নগরে আনার মাধ্যমে একদিকে নিরাপদ ও সতেজ খাদ্যের জোগানের প্রচেষ্টা যেমন চলছে, তেমন পৃথিবীকে সবুজ রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আধুনিক বিশ্ব।
ঢাকায় নগরকৃষি বা শহরভিত্তিক কৃষিচর্চার প্রয়োজনীয়তা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, কারণ দ্রুত নগরায়ণের ফলে সবুজ জায়গা কমে আসছে এবং খাদ্যনিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ছে। জনসংখ্যার চাপ, দূষণ, জলাবদ্ধতা ও দাবদাহের মতো নগর সমস্যাগুলোর টেকসই সমাধানে ছাদবাগান, বারান্দা চাষ বা উন্মুক্ত স্থানে সবজি চাষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। নগরকৃষি শুধু বাসাবাড়িতে টাটকা ফল ও সবজির জোগানই দেয় না, বরং পরিবেশবান্ধব জীবনযাত্রা গড়তেও সহায়ক হয়। এটি বেকারত্ব হ্রাস, মানসিক প্রশান্তি, আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ ও জৈববর্জ্য পুনর্ব্যবহারের মাধ্যমে একটি স্বনির্ভর ও সবুজ ঢাকা গড়ে তোলার পথ খুলে দেয়।
এখন অনেকেই বিকল্প আয়ের পথ হিসেবে বেছে নিচ্ছেন নিজেদের ভবনের ছাদ। এমনই এক অনন্য উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে এসেছেন মাসুদ রেজা নামের একজন অভিজ্ঞ নার্সারি উদ্যোক্তা, যিনি ঢাকার মণিপুরিপাড়ার মাত্র ২ হাজার ২০০ বর্গফুটের ছাদে গড়ে তুলেছেন ব্যতিক্রমী এক চারা উৎপাদন কেন্দ্র। প্রথম দেখাতে ছাদটি হয়তো আর ১০টি সবুজ ছাদের মতোই মনে হবে, তবে একটু ভালোভাবে লক্ষ করলেই বোঝা যায় এখানে চলছে পরিকল্পিত ও বৈজ্ঞানিক নার্সারি কার্যক্রম। শৌখিন বৃক্ষ যেমন কাঠগোলাপ, ইউফরবিয়া থেকে শুরু করে ফলের চারা যেমন আনার ও অড়বরই অনেক কিছুই রয়েছে এখানে। এ নার্সারির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো কাঠগোলাপের ব্যতিক্রমী সংগ্রহ। তিনি বিদেশ থেকে উন্নত জাতের সায়ন এনে দেশীয় কাঠগোলাপে গ্রাফটিং করে তৈরি করেছেন রংবৈচিত্র্যময় ৬০টি জাত। গ্রাফটিং পদ্ধতির মাধ্যমে তিনি কেবল নতুন জাত তৈরি করেননি, বরং এসব চারা চাষযোগ্য এবং অর্থনৈতিকভাবে টেকসই করেছেন। এটি নিছক শখ নয়, বরং বাজার বুঝে, চাহিদা যাচাই করে প্রস্তুতকৃত একটি আধুনিক নার্সারি। মাসুদ রেজার এ কার্যক্রমের শুরু ২০১৯ সালে। এর আগে তিনি দীর্ঘদিন ধরে নার্সারি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরবর্তী সময়ে নানা প্রতিকূলতায় তাঁর নার্সারি বন্ধ হয়ে গেলে তিনি নতুন করে ভাবেন যে ছাদ ফাঁকা পড়ে আছে, সেখানেই যদি শুরু হয় নতুন এক সবুজ যাত্রা! সেই ভাবনাই আজ বাস্তবতা।
তিনি বলেন, “দেশের মানুষের রুচি বদলেছে। আপনার ‘ছাদকৃষি’ কার্যক্রমের ব্যাপক প্রচারণায় নগরের মানুষ এখন কৃষিতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। যার ছাদ নেই, তিনিও বারান্দায় বা বেলকনিতে গাছ লাগিয়ে এ চর্চার সঙ্গে যুক্ত থাকতে চাচ্ছেন। আগে গাছ মানেই গ্রামের ব্যাপার ছিল, এখন শহরের বাসিন্দারাও গাছের জন্য খুঁজে নিচ্ছেন ছাদ, বারান্দা কিংবা জানালার সামান্য জায়গাই।” নগরবাসীর এ পরিবর্তিত রুচিই মাসুদ রেজাকে আশাবাদী করে তুলেছে।
বর্তমানে দেশে সরকারিভাবে তালিকাভুক্ত নার্সারির সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার। তবে বাস্তবচিত্রে এ সংখ্যার বাইরে আরও অসংখ্য অনানুষ্ঠানিক নার্সারি ছড়িয়ে আছে দেশজুড়ে। এত বিস্তৃত বাজার থাকা সত্ত্বেও মানসম্মত চারার অভাব রয়েছে ব্যাপকভাবে। অনেকে যথাযথ জ্ঞান ছাড়াই চারা তৈরি করেন, যা শেষ পর্যন্ত চাষির জন্য ক্ষতির কারণ হয়। মাসুদ রেজার মতে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এখন সবার হাতের মুঠোয়। পরিকল্পিতভাবে কাজ করলে যে কেউ ভালো মানের চারা তৈরি করতে পারেন। ছাদে চারা উৎপাদনের ক্ষেত্রে তিনি গবেষণা করেছেন ফলের ওপরেও। আনারের সফল ফলন পেয়ে তিনি এখন চারা উৎপাদনে মনোযোগী। পাশাপাশি অড়বরইয়ের মধ্যেও সম্ভাবনার ইঙ্গিত পেয়েছেন। তাঁর মতে, সব ফসল ছাদে হয় না, তাই ছাদের ধরন বুঝে ফসল নির্বাচন করা গুরুত্বপূর্ণ।
পরিকল্পনা করে এবং সীমিত পরিসরেও যদি চাষের উপযোগী জাত নির্বাচন করে নার্সারির কাজ চালানো যায়, এটি হয়ে উঠতে পারে একটি লাভজনক উদ্যোগ। বিশেষ করে তরুণ-তরুণী, গৃহিণী কিংবা চাকরি শেষে কিছু করতে চাওয়া যে কেউ-ই এ মডেল অনুসরণ করে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারেন।
আরেকটি দিক হলো এ ধরনের নার্সারিগুলো পরিবেশবান্ধব। শহর প্রতিদিন যে হারে সবুজ হারাচ্ছে, সেখানে এক ছাদে হলেও যদি নতুন গাছ তৈরি হয়, তাহলে তা শুধু উদ্যোক্তার জন্য নয়, পুরো শহরের জন্যই উপকারী। এ উদ্যোগে যেমন অর্থ আসে, তেমনি আসে বিশুদ্ধ বাতাস, পরিবেশের ভারসাম্য, আর মানসিক প্রশান্তি। যদি ছাদটিকে ফেলে রাখেন ধুলো আর পরিত্যক্ত জিনিসের গুদাম হিসেবে, তবে তার কোনো মূল্য নেই। কিন্তু চাইলে সেই ছাদ হয়ে উঠতে পারে সবুজ নার্সারি, পরিবারের পুষ্টির উৎস, এমনকি বাড়তি আয়ের পন্থা। প্রয়োজন শুধু সঠিক জাতের চারা, কিছু সময়, আর যত্ন। মাসুদ রেজা প্রমাণ করেছেন, ইচ্ছা আর পরিকল্পনা থাকলে সীমিত পরিসরও বড় সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে। তাঁর ছাদকৃষি নার্সারি যেন আমাদের দেখিয়ে দেয় সবুজ মানে শুধু প্রকৃতি নয়, সবুজ মানে সম্ভাবনা, টেকসই উন্নয়ন এবং আত্মনির্ভরতা। তাঁর এ পথ ধরেই হয়তো গড়ে উঠবে আগামী দিনের টেকসই সবুজ অর্থনীতি।
লেখক : মিডিয়াব্যক্তিত্ব