বর্তমান সময়ে আমাদের সমাজে যেভাবে তাবিজ, কুফরি কালাম ও কালো জাদুর প্রবণতা বাড়ছে, তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এসবের মাধ্যমে কেউ শারীরিকভাবে অসুস্থ হচ্ছে, কেউ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, আবার কেউ পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে বিপর্যস্ত হচ্ছে। এমনকি সন্তানদের লেখাপড়ার পথেও বাধা তৈরি করছে এই তাবিজ, জাদু ও কুফরি। ঘরে ঘরে অশান্তি, স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদ, ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়া-এসবের ক্ষেত্রে তাবিজের ব্যবহারের কথা শোনা যায়। এসব তাবিজ ব্যবসায়ীরা আধ্যাত্মিকতার নাম করে, সাধারণত ধর্মের পোশাক পরে, ‘হুজুর’ বা ধর্মগুরু সেজে সহজসরল মানুষের বিশ্বাস অর্জন করে। তারা বলে, ‘তাবিজ দিলে সব সমস্যা মিটে যাবে’। অথচ বাস্তবে কুফরি ও শয়তানি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে টাকা উপার্জনই তাদের উদ্দেশ্য। বিশেষ করে সহজসরল ও আবেগপ্রবণ নারীরা এদের প্রধান টার্গেট।
মাঝেমধ্যে ব্ল্যাকমেল, অবৈধ সম্পর্ক, এমনকি টাকা আদায়ের ভয়াবহ সব কাহিনি বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে জানা যায়। ব্যক্তিগতভাবে চেনা একজন আলেমের পরিবারের হৃদয়বিদারক ঘটনার সাক্ষী আমি। তার বোন নির্ধারিত সময়ের আগেই সন্তান জন্ম দেন এবং অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে এখন কোমায়। চিকিৎসায় সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ মিলছিল না। পরে এক আলেম নিশ্চিত করেন, এটি ছিল ‘কালো জাদু’র প্রভাব। আজ সেই নারী দুটি সন্তান রেখে বিছানায় পড়ে আছেন, তার শরীর হাড্ডিসার। তিনি জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। এ ঘটনার পেছনে রয়েছে কিছু লেবাসধারী মানুষ। যারা আলেমের বেশ ধরে সমাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে, অথচ কাজ করছে শয়তানের মতো। এরা টাকাপয়সার বিনিময়ে মানুষের ক্ষতি করছে।
কথার ফাঁদে ফেলে, ভয় দেখিয়ে, ধোঁকা দিয়ে, জাদু-তাবিজ দিয়ে সর্বনাশ করছে অসংখ্য মানুষের। এদের বলা চলে ‘নিরস্ত্র খুনি’। কারণ তারা অস্ত্র ছাড়াই মানুষের জীবন নষ্ট করে দেয়।
ইসলামে এ ধরনের জাদু-তাবিজ সম্পর্কে কঠোর বার্তা রয়েছে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘সুলাইমান (আ.) কুফরি করেননি, বরং শয়তানরাই কুফরি করেছিল। তারা মানুষকে জাদু শেখাত’ (সুরা আল-বাকারা-১০২)। হাদিস শরিফে রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা সাতটি ধ্বংসকারী কাজ থেকে দূরে থাক।’ সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রসুল! সেগুলো কী কী?’ তিনি বললেন, ‘আল্লাহর সঙ্গে শিরক করা, জাদু করা, নির্দোষ কাউকে হত্যা করা, সুদ খাওয়া, এতিমের সম্পদ আত্মসাৎ করা, যুদ্ধ থেকে পলায়ন, ও পবিত্র নারীদের অপবাদ দেওয়া’ (বুখারি-২৭৬৬)। অন্য এক হাদিসে রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি তাবিজ ঝোলাল, সে শিরক করল’ (মুসলিম-৫৭৩৭)।
যারা জাদুর আশ্রয় নিয়ে মানুষের ক্ষতি কামনা করে, আর যারা জাদু করে-তারা আসলে সমাজের জন্য ‘নিরস্ত্র ঘাতক’। এদের বিরুদ্ধে প্রতারণার আইনসহ অন্যান্য আইন প্রয়োগের সুযোগ থাকলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ দেখা যায় না। অথচ একজন মানুষ যদি আরেকজনকে মারধর করে, তার শাস্তি হয়। তাহলে যেসব প্রতারক জাদুর নামে প্রতারণা বা অপচিকিৎসা করে মানুষের জীবন শেষ করে দিচ্ছে, তাদের কেন বিচারের মুখোমুখি করা হবে না? সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচিত এদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ নিশ্চিত করা। তাবিজ ব্যবসা মানে শুধু প্রতারণা নয়, এটি মানুষের জীবন, সংসার ও ভবিষ্যৎ ধ্বংস করার এক ভয়ংকর অস্ত্র।
আইন ও সমাজ-এই দুই পক্ষেরই দায়িত্ব হলো এ ধরনের জাদুকর, তাবিজ ব্যবসায়ী ও কুফরির সঙ্গে জড়িত প্রতারকদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা। পাশাপাশি মানুষকে সচেতন করা। বিশেষ করে নারীদের। কারণ তাদের আবেগকেই এরা বেশি ব্যবহার করে ফায়দা লোটে। মনে রাখতে হবে, সব সমস্যার সমাধান কেবল আল্লাহর হাতে, তাবিজের কোনো ক্ষমতা নেই। যারা জাদু-তাবিজের নামে মানুষকে ধোঁকা দিচ্ছে, জীবনের ক্ষতি করছে, তারা শুধু দুনিয়ায় অপরাধী নয়, আখেরাতেও কঠিন শাস্তির মুখে পড়বে। সবার উচিত এসব প্রতারককে প্রতিহত করা। এই শয়তানি চক্রকে যত দিন দমানো না যাবে, তত দিন সমাজে শান্তি ফিরবে না। ধর্মের নামে যারা ব্যবসা করে, আল্লাহ তাদের বিচার করবেনই, কিন্তু দুনিয়াতেও তাদের প্রতিরোধ করা আমাদের দায়িত্ব। সচেতন মানুষ হিসেবে আমাদের সমাজে এসব অন্যায়কে ‘না’ বলতে শিখতে হবে।
লেখক : পরিচালক, চরপাথালিয়া সালমান ফারসি (রা.) মাদরাসা, গজারিয়া, মুন্সিগঞ্জ