মানবাধিকার। যার সহজ অর্থ হচ্ছে মানুষের অধিকার। বর্তমান সময়ের একটি আলোচিত শব্দ মানবাধিকার। পৃথিবীতে পবিত্র ইসলামের আগমনের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও মানুষের মর্যাদা সুনিশ্চিত করা। মানুষ অন্য সব সৃষ্টির ওপর শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করবে- এটাই ইসলামের অভিপ্রায়। মানবাধিকার বিষয়ে ইসলামের শিক্ষাই সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষা এবং কিয়ামত পর্যন্ত প্রত্যেক যুগেই তা কার্যকর। প্রত্যেক মানুষ অন্য মানুষকে তার নিজের মতোই মনে করবে, অন্যের অধিকারকে নিজের অধিকার মনে করবে, অন্যের পছন্দকে নিজের পছন্দ মনে করবে-ইসলাম সেই শিক্ষাই দিয়েছে। ইসলামের নবী মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কত চমৎকার করে বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ ততক্ষণ মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না নিজের ভাইয়ের জন্য সেটাই পছন্দ করবে, যা পছন্দ করবে নিজের জন্য।’ (বুখারি)।
রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেন, ‘তোমরা জান্নাতে যেতে পারবে না, যতক্ষণ না তোমরা ইমান আনবে আর ইমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ না তোমরা পরস্পরকে ভালোবাসবে।’ (সহিহ মুসলিম)। ইসলাম আরও বলে, ‘যে নিজেকে ইমানদার দাবি করে, সে যেন প্রতিবেশীর অধিকার রক্ষা করে। (সহিহ বুখারি)। এতিমদের সম্পদ গ্রাস না করতে ইসলাম বারবার তাগিদ দিয়েছে। এতিমের অধিকার প্রতিষ্ঠায় পবিত্র কোরআনুল কারিমে সুস্পষ্টভাবে ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা এতিমদের অর্থসম্পদ অন্যায়ভাবে খায়, তারা নিজেদের পেটে আগুনই ভর্তি করেছে এবং শিগগিরই তারা অগ্নিতে প্রবেশ করবে।’ (সুরা নিসা-১০)। মুসাফির, মেহমান, অসহায়, সহকর্মী, সহযাত্রী-কারও অধিকারের কথা বর্ণনা করতে ইসলাম কার্পণ্য করেনি। এক কথায় একজন মানুষকে জীবন চলার পথে যত মানুষের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হতে হয়, প্রত্যেকের অধিকারের কথাই ইসলাম বলেছে। পবিত্র কোরআনুল কারিমের দৃপ্ত ঘোষণা-‘আর উপাসনা কর আল্লাহর, শরিক কর না তাঁর সঙ্গে অপর কাউকে। পিতা-মাতার সঙ্গে সৎ ও সদয় ব্যবহার কর এবং নিকটাত্মীয়, এতিম-মিসকিন, প্রতিবেশী, অসহায় মুসাফির এবং নিজের দাস-দাসীর প্রতিও। নিশ্চয়ই আল্লাহ পছন্দ করেন না দাম্ভিক-গর্বিতজনকে।’ (সুরা নিসা-৩৬)। ইসলাম আল্লাহর সিজদাহ করাকে যেমন ইবাদত গণ্য করে, ঠিক তেমনি ইবাদত গণ্য করে মানবাধিকারের প্রতি যত্নবান হওয়াকে। বিদায় হজের ভাষণে ইসলামের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করেন, ‘আজকের এই মাস, দিন এবং শহর তোমাদের কাছে যেমন পবিত্র, ঠিক তেমনই পবিত্র তোমাদের একজনের কাছে আরেকজনের জীবন, সম্পদ ও সম্মান।’ ইসলামের ঘোষণা, কেউ কারও অধিকার হরণ করলে আল্লাহ তা ক্ষমা করবেন না, যতক্ষণ না যার অধিকার হরণ করা হয়েছে, সে ক্ষমা করে দেয়। ইসলাম শুধু মুসলমানদের পারস্পরিক অধিকারের কথাই বলে না, অন্য ধর্মাবলম্বীদের অধিকারের প্রতিও যত্নবান হতে বলে। সেই শিক্ষা আমরা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন থেকে পাই।
মদিনায় হিজরতের পর রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনা সনদ তৈরির মাধ্যমে শুধু মুসলিমদের নয়, বরং সেখানকার সব ধর্ম ও গোত্রের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যুদ্ধের ময়দানেও তিনি মানবাধিকারের প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখতেন। কোনো নারী, বৃদ্ধ কিংবা কোনো ঘরে আশ্রয় নেওয়া শত্রুকেও যেন আক্রমণ করা না হয়, সে ব্যাপারে তিনি অনুসারীদের কঠোরভাবে নির্দেশ দিতেন। সীমান্তে টহল দেওয়ার সময় জনৈক কাফের মুসলিম দলের হাতে নিহত হলে মহানবী (সা.) মুসলিম দলকে ভর্ৎসনা করেন এবং নিহতের ক্ষতিপূরণ আদায় করে দেন। যুদ্ধবন্দিদের সঙ্গে তিনি এমনই মানবিক আচরণ করতেন যে মুগ্ধ হয়ে তারা ইসলাম গ্রহণ করত।
এই তো গেল ইসলামের মানবাধিকার প্রদানের অনন্য নির্দেশনার সামান্য চিত্র। পক্ষান্তরে আজ পৃথিবীর দিকে থাকালে দেখা যায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের কী ভয়াল চিত্র। বিলিয়ন বিলিয়ন অর্থ খরচ করে তৈরি হচ্ছে মারণাস্ত্র। অস্ত্রের পরীক্ষা যেন প্রতিযোগিতার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মানবতা আজ বিপন্ন । নিরস্ত্র-দুর্বল মানবগোষ্ঠী আজ অস্ত্রবাজদের নিপীড়নে জর্জরিত হচ্ছে। আজ ফিলিস্তিন মৃত্যুপুরী। অর্ধলক্ষাধিক ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছে। প্রতিনিয়ত শহীদের মিছিল দীর্ঘই হচ্ছে। চরমভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন হওয়া সত্ত্বেও বিশ্বসম্প্রদায় আজ মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। ক্ষেত্রবিশেষে মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোড়া ইসরায়েলকে আরও হিংস্রতায় মেতে উঠতে উৎসাহ জোগাচ্ছে পশ্চিমা বিশ্ব। শুধু মুসলিমরাই, কৃষ্ণাঙ্গ অমুসলিমদের সঙ্গে শুধু কৃষ্ণাঙ্গ হওয়ায় তাদের সঙ্গে কী অমানবিক আচরণ করা হয়, কীভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়, তা তো মিডিয়ায় আমরা নিয়মিত দেখছি।
সুতরাং একটি সুখময় শান্তিপূর্ণ পৃথিবী গড়ে তুলতে ইসলামপ্রদত্ত মানবাধিকারের নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়নের বিকল্প নেই।
লেখক : খতিব, আউচপাড়া জামে মসজিদ, টঙ্গী, গাজীপুর