নাম দেলোয়ার হোসেন, যিনি একসময় ঢাকাই চলচ্চিত্রে এসে হয়ে যান দিলদার। ঢালিউডে কমেডিয়ান হিসেবে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ‘কমেডি’ শব্দের প্রতিশব্দ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। চার দশকের কম সময়ে দিলদার দেখা দিয়েছেন ৫০০-এর বেশি সিনেমায়। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন কীভাবে রাজত্ব করতে হয়। কীভাবে কমেডিয়ানের গণ্ডি ডিঙিয়ে হয়ে উঠতে হয় একচ্ছত্র নায়ক। তাই মৃত্যুর এত বছর পরেও দিলদার এখনো সমান প্রাসঙ্গিক; সমান জনপ্রিয়। একসময় তো নির্মাতারা বলতেন- সিনেমায় গল্প, রোমান্স, অ্যাকশন, সাসপেন্স লাগবে আর লাগবে দিলদার। সেই সময়টায় এতটাই অপরিহার্য ছিলেন তিনি। এমনকি তাঁর জনপ্রিয়তা ছাড়িয়ে গিয়েছিল অনেক নায়ক-নায়িকার থেকেও।
একবার নির্মাতা মালেক আফসারী উত্তরায় শুটিং করছিলেন। নায়ক-নায়িকার অটোগ্রাফ নিতে ভিড় করছিল অনেকে। হট্টগোল দেখে নায়ক-নায়িকা দুজনই বিরক্ত হচ্ছিলেন। এর মধ্যে শুটিং সেটে আসে দিলদারের গাড়ি। ‘চাল্লি আসছে’ বলে চিৎকার করে উঠল সবাই। নায়ক-নায়িকাকে ফেলে দিলদারের গাড়ি ঘিরে ফেলল অটোগ্রাফ নিতে। এদিকে নায়ক-নায়িকা বসে থাকলেন বেজার মুখে। দিলদারের কমেডিয়ান থেকে নায়ক হওয়ার গল্পও সব গল্পকে হার মানাবে। তিনি তোজাম্মেল হক বকুলের ‘আব্দুল্লাহ্’ সিনেমায় নায়ক হন। নির্মাতার কাছে নায়কের প্রস্তাব পেয়ে অবাক হয়েছিলেন তিনি। বলেন, ‘আপনি কি আমার পেটে লাথি দিতে আসছেন?’ অনেক অনুরোধের পর রাজি হন দিলদার।
তবে তাঁর বিপরীতে কে হবেন নায়িকা? এ নিয়ে সৃষ্টি হয়েছিল জটিলতা। প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন মৌসুমী, শাবনূরসহ বেশ কয়েকজন নায়িকা। এরপর নূতনের কাছে প্রস্তাব নিয়ে যান নির্মাতা। সম্মতি জানান তিনি। এরপর থেকে নূতনের কাছে অনেক ফোন আসতে শুরু করে, তিনি যেন সিনেমাটি না করেন! কিন্তু দমে যাননি নূতন। সিনেমাটি তৈরির পরেও নির্মাতা ও প্রযোজক ছিলেন ভয়ের মধ্যে। কেন দিলদারকে নিয়ে এ ঝুঁঁকি নিয়েছেন, হল মালিকদের কাছ থেকেও শুনতে হয়েছে এমন প্রশ্ন। তবে মুক্তির পর বদলে যায় দৃশ্যপট। প্রথম দিন থেকে হলে ভিড় জমায় দর্শক। প্রযোজক জানান, ১৯৯৭ সালে ২০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত আব্দুল্লাহ্ ছবিটি প্রায় ৫ কোটি টাকার ব্যবসা করেছিল। যেটা সত্যিই অবাক করা বিষয়। দিলদার পর্দায় অভিনয় দিয়ে যেমন দর্শকদের মাতিয়ে রাখতেন, তেমনি শুটিং সেটেও হাসিখুশি থাকতেন। সহশিল্পীদের সাহস জোগাতেন ভালো কাজ করার জন্য। দুলারির সঙ্গে জুটি হয়ে অনেক সিনেমায় অভিনয় করেছেন দিলদার। ‘দাঙ্গা’ তার মধ্যে অন্যতম, সিনেমাটি ভারতেও রিমেক হয়। টলিউডের ওই সিনেমায়ও ছিলেন দিলদার। তখনো দুলারি ভারতের কোনো সিনেমায় অভিনয় করেননি, বিদেশের মাটিতে গিয়ে তাই অনেকটা ভয়ে ছিলেন। সে সময় তাঁকে সাহস দেন দিলদার। বলেন, দেশের সিনেমায় পারলে ভারতে কেন সে পারবে না! শুটিংয়ে গিয়েও দুলারিকে অনেক সাপোর্ট করেন দিলদার। শুটিংয়ের ফাঁকে দুলারিকে নিয়ে গিয়েছিলেন নিউমার্কেটে। অনেকে তাঁকে জিজ্ঞেস করছিল- ইনি আপনার কী হন? মজা করে দিলদার তাঁকে স্ত্রী বলেই পরিচয় দেন। দুজনের উচ্চতার পার্থক্য দেখে সবাই বেশ মজা পাচ্ছিল। দুলারি তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, সবাইকে কেন এমনটা বলছেন? দিলদার উত্তর দেন- ‘সমস্যা কী! সবাই তো মজা পাচ্ছে।’
শুধু ক্যামেরার সামনে নয়, পর্দার বাইরেও সবাইকে আনন্দ দিতে পছন্দ করতেন তিনি। সিনেমায় ব্যস্ত থাকলেও পরিবারের প্রতি সমান দায়িত্বশীল ছিলেন দিলদার। কখনোই রাত ১০টার পর শুটিং সেটে থাকতেন না। ফিরে যেতেন বাড়িতে। পরিবারের অর্থনৈতিক দিকটাও সব সময় মাথায় রাখতেন। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে জীবদ্দশায় দুটি বাড়ি করে গেছেন। এখনো সেই বাড়ির ভাড়ার টাকায় চলেন তাঁর স্ত্রী রোকেয়া বেগম। চেষ্টা করেন গরিব মানুষদের সাধ্যমতো সহায়তা করার। দিলদারের দুই মেয়ে মাসুমা আক্তার ও জিনিয়া আফরোজ-দুজনেই প্রতিষ্ঠিত। তাঁরাও খেয়াল রাখেন মায়ের।