উড়োজাহাজ থেকে কোটি কোটি মাছি ছড়িয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু এটি কোনো আতঙ্কের গল্প নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রের একটি সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ যা দেশটির গবাদিপশুকে এক মারাত্মক হুমকি থেকে রক্ষা করার জন্য নেওয়া হচ্ছে। এই হুমকি হলো 'নিউ ওয়ার্ল্ড স্ক্রুওর্ম' নামক এক মাংসখেকো মাছির লার্ভা, যা যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে মারাত্মক ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে।
এই 'মাংসখেকো' মাছিটির বৈজ্ঞানিক নাম Cochliomyia hominivorax। এর লার্ভা, যা 'নিউ ওয়ার্ল্ড স্ক্রুওর্ম' নামে পরিচিত, উষ্ণ রক্তের প্রাণীর ক্ষতস্থানে বাসা বাঁধে এবং জীবিত অবস্থাতেই তাদের মাংস খাওয়া শুরু করে। এর আক্রমণের ফলে আক্রান্ত পশু এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে মারাও যেতে পারে। বিরল হলেও, এই লার্ভা মানুষকেও আক্রান্ত করতে পারে বলে জানা গেছে। টেক্সাস এঅ্যান্ডএম ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ফিলিপ কাফম্যানের মতে, এই লার্ভা ঘোড়া, গরুসহ বেশিরভাগ উষ্ণ রক্তের প্রাণীর মাংস খেয়ে থাকে।
কাফম্যান ব্যাখ্যা করেছেন যে, পুরুষ মাছির সংস্পর্শে আসার পর স্ত্রী মাছি জীবিত কোনো প্রাণীর ক্ষতস্থানে বসে এবং সেখানে ২০০ থেকে ৩০০টি ডিম পাড়ে। মাত্র ১২ থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ডিম ফুটে লার্ভা বের হয়। এরপরই লার্ভাগুলো দ্রুত ওই প্রাণীর মাংস খাওয়া শুরু করে এবং একপর্যায়ে পূর্ণ মাছিতে পরিণত হয়। এই দ্রুত বংশবিস্তারের কারণে নিউ ওয়ার্ল্ড স্ক্রুওর্ম মারাত্মক বিপদ ডেকে আনতে পারে। এই লার্ভায় আক্রান্ত হওয়া ঠেকাতে এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর টিকা আবিষ্কার হয়নি। টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের পশুস্বাস্থ্য কমিশনের উপনির্বাহী পরিচালক থমাস ল্যানসফোর্ড বলেন, আক্রান্ত পশুগুলোকে প্রায়ই পরিষ্কার করতে হয়, ক্ষতস্থানে অ্যান্টিসেপটিক দিতে হয় এবং ক্ষতস্থান ঢেকে রাখতে হয়।
২০২৩ সালের শুরুর দিক থেকে এই লার্ভা মধ্য আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে। পানামা, কোস্টারিকা, নিকারাগুয়া, হন্ডুরাস, গুয়াতেমালা, বেলিজ ও এল সালভাদরে এর ব্যাপক উপদ্রব দেখা যায়। গত নভেম্বরে এই লার্ভা মেক্সিকোর দক্ষিণাঞ্চলেও পৌঁছে যায়। এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্ত এলাকায় গবাদিপশু, ঘোড়া ও বাইসন বাণিজ্যে ব্যবহৃত হয়—এমন কয়েকটি বন্দর বন্ধ করে দেওয়া হয়। এই লার্ভার দ্রুত বিস্তার যুক্তরাষ্ট্রের পশুপালন শিল্পের জন্য এক বিশাল হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবে পোকা দিয়ে পোকা দমনের প্রচেষ্টা যুক্তরাষ্ট্রে এই প্রথম নয়। ষাট ও সত্তরের দশকে নিউ ওয়ার্ল্ড স্ক্রুওর্ম দমনে দেশটি বড় সফলতা অর্জন করেছিল। সেসময় প্রজননে অক্ষম পুরুষ মাছি চাষ করা হয়েছিল এবং উড়োজাহাজ থেকে স্ত্রী মাছির সঙ্গে মিলনের জন্য সেগুলো ছেড়ে দেওয়া হয়। যেহেতু পুরুষ মাছিগুলো প্রজননে অক্ষম ছিল, স্ত্রী মাছিরা ডিম পাড়তে পারেনি, ফলে বংশবিস্তারও হয়নি। এই পদ্ধতি সেবার যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপক সফলতা পেয়েছিল এবং দেশটিকে এই মারাত্মক কীট থেকে মুক্ত করতে সাহায্য করেছিল।
সেই ঐতিহাসিক সাফল্যের অনুপ্রেরণায়, মার্কিন আইনপ্রণেতারা বর্তমানে এই পদ্ধতি আবারও কাজে লাগাতে চাইছেন। গত ১৭ জুন ৮০ জন মার্কিন আইনপ্রণেতা প্রজননে অক্ষম মাছি চাষের জন্য একটি চিঠি পাঠান। পরের দিনই যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেয় যে, এই মাছি চাষের জন্য মেক্সিকো-টেক্সাস সীমান্তের কাছে একটি 'কারখানা' নির্মাণ করা হবে। নিউ ওয়ার্ল্ড স্ক্রুওর্ম দমনে যুক্তরাষ্ট্র ও পানামার যৌথ কমিশন 'সিওপিইজি'–এর তথ্য অনুযায়ী, তারা প্রতি সপ্তাহে প্রায় ১০ কোটি মাছি উৎপাদন করে এবং মেক্সিকোসহ মধ্য আমেরিকার আক্রান্ত এলাকাগুলোয় উড়োজাহাজ থেকে ছেড়ে দেয়। সেখানেই এই মাছির লার্ভার উপদ্রব শনাক্ত হয়েছে।
ধারণা করা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রে মাছি তৈরির জন্য টেক্সাসের হিডালগো এলাকায় মুর বিমানঘাঁটির কাছে একটি স্থাপনা গড়ে তোলা হবে। সেখানে উৎপাদন থেকে শুরু করে মাছি অবমুক্ত করা পর্যন্ত কাজে প্রতিবারে প্রায় ৮৫ লাখ ডলার খরচ হতে পারে। যদিও ওই স্থাপনাটি নির্মাণে কত খরচ হবে তা প্রকাশ করা হয়নি, মার্কিন আইনপ্রণেতাদের ধারণা, এটি কমবেশি ৩০ কোটি ডলার হতে পারে। টেক্সাসের গবাদিপশু পালনকারী স্টিফেন ডিয়েবেল বলেন, এই পরিকল্পনা ব্যয়বহুল হলেও, এর বিনিময়ে কয়েকশ কোটি ডলারের পশুপালন শিল্প রক্ষা পাবে। অধ্যাপক ফিলিপ কাফম্যানের মতে, স্ত্রী মাছিগুলো প্রায় ২০ দিন বেঁচে থাকে এবং এই সময়ে তারা পুরুষ মাছির সঙ্গে মাত্র একবার মিলিত হয়। প্রজননে অক্ষম পুরুষ মাছির সাথে স্ত্রী মাছির মিলনের ফলে নতুন করে বংশবিস্তার না হলে কয়েক মাস বা বছরের মধ্যে এই উপদ্রব শেষ হয়ে যেতে পারে। এই পদক্ষেপ সফল হলে, যুক্তরাষ্ট্র আবারও নিউ ওয়ার্ল্ড স্ক্রুওর্মের হুমকি থেকে নিজেদের পশুপালন শিল্পকে রক্ষা করতে সক্ষম হবে।
সূত্র: সিএনএন
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল