চীনের ইনার মঙ্গোলিয়ার বায়ান ওবো শহরের একসময় সবুজ তৃণভূমি আজ ধূসর ধুলায় ঢাকা। বিরল খনিজ ধাতু উত্তোলনের নামে যুগের পর যুগ খনন করে অঞ্চলটিকে এক বিপর্যস্ত রূপে পরিণত করেছে চীন। অথচ বায়ান ওবো ছাড়া আধুনিক প্রযুক্তিপ্রেমী বিশ্বের জীবনযাপন যেন থমকে যাবে। কারণ, পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক বিরল খনিজ ধাতু মজুত রয়েছে এখানেই। মোবাইল, ব্লুটুথ, বৈদ্যুতিক গাড়ি, টিভির স্ক্রিন—প্রায় সব আধুনিক প্রযুক্তিই এই খনিজের ওপর নির্ভরশীল।
চীন বর্তমানে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে এই ধাতু উত্তোলন ও পরিশোধন করে, যার ফলে তারা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে শক্ত অবস্থানে রয়েছে। যেমন—ট্রাম্প প্রশাসনের সময় শুল্ক নিয়ে চীনের দৃঢ় অবস্থানের পেছনেও এই খনিজের বড় ভূমিকা ছিল। তবে এই খনিজ উত্তোলনের খেসারত দিতে হয়েছে চীনকেও। বিবিসির অনুসন্ধানে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
বিবিসি প্রতিনিধি দল উত্তর চীনের বায়ান ওবো এবং দক্ষিণের গানঝৌ প্রদেশ পরিদর্শন করে দেখতে পেয়েছেন তেজস্ক্রিয় বর্জ্যে পূর্ণ কৃত্রিম হ্রদ, বিষাক্ত লিচিং পুকুর এবং খোলা আকাশের নিচে থাকা বর্জ্যের স্তূপ। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, পানি ও মাটির দূষণে ক্যানসার, শিশুর জন্মগত ত্রুটি, এমনকি অঙ্গ-প্রতঙ্গ বিকৃতির মতো ভয়াবহ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।
১৯৯৯ সাল পর্যন্ত অতিরিক্ত খনন ও বর্জ্য ফেলার কারণে এক বিশাল সমস্যা তৈরি হয়। ২০১৩ সালে নতুন খনি চালু হয়। ফলে গত ২৫ বছরে খনি এলাকা দ্বিগুণ হয়েছে। দক্ষিণে গানঝৌ শহরের পাহাড়ের চূড়ায় বিষাক্ত লিচিং পুকুর তৈরি হয়, যেখানে রাসায়নিক ব্যবহার করে মাটি থেকে খনিজ আলাদা করা হয়। এসব পুকুর খোলা থাকায় দূষণ ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে ও বৃষ্টির পানিতে।
স্থানীয় কৃষক হুয়াং শিয়াওচং জানান, চারদিকে খনি থাকার কারণে ভূমিধস এখনো হচ্ছে এবং একটি রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি তার জমি দখল করেছে। তিনি সরকারি দপ্তরে অভিযোগ করলেও কোম্পানির পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। তার মতে, এটা আমার একার পক্ষে সামলানো সম্ভব না। এই সমস্যা সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের দেখার দরকার।
হুয়াংয়ের সাক্ষাৎকারের সময় বিবিসির প্রতিনিধিদের ঘিরে ধরে খনি কোম্পানির ইউনিফর্ম পরা লোকজন। তারা গাড়ি আটকে রাখে এবং পরবর্তীতে স্থানীয় ব্যবস্থাপক এসে তর্কে জড়ান ও তিন ঘণ্টা আটকে রাখেন সাংবাদিকদের।
অধ্যাপক জুলি ক্লিংগার বলেন, আগে উন্নয়ন করো, পরে পরিচ্ছন্নতা—চীনের এই নীতির বলি হয়েছেন খনি এলাকার সাধারণ মানুষ। তিনি জানান, বায়ান ওবোর পাশে বাওটো শহরের বিশাল বর্জ্য হ্রদের আশপাশের অঞ্চলে ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা গেছে। অতিরিক্ত ফ্লোরাইড ও আর্সেনিকে বহু মানুষের হাড় ও অস্থিসন্ধিতে বিকৃতি হয়েছে।
বিরল খনিজ উত্তোলনের জন্য প্রতি টন ধাতুতে প্রায় ২০০০ টন বিষাক্ত বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এসব বর্জ্য জমে আছে বিশাল পুকুরে, যেগুলো ধীরে ধীরে চীনের দ্বিতীয় বৃহত্তম নদী ইয়েলো রিভারের দিকে ছড়িয়ে পড়ছে—যা উত্তর চীনের পানির প্রধান উৎস।
চীন কিছুটা চেষ্টা করছে পরিবেশগত ক্ষতি নিয়ন্ত্রণে আনতে, কিন্তু এরই মধ্যে যা হারিয়েছে তা ফিরে পাওয়া কঠিন। যুক্তরাষ্ট্রসহ আরও অনেক দেশ এখন নিজেরাই খনিজ উত্তোলনে আগ্রহী হলেও বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে বলেছেন, যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলেও ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটতে পারে।
তবুও বায়ান ওবোর অনেকে এই খনিজ নির্ভর জীবনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছেন। যেমন এক কৃষক জানান, খনি থেকে এখন মাসে পাঁচ থেকে ছয় হাজার ইউয়ান আয় করেন। আগে তিনি ঘোড়া চরাতেন, এখন জমিতে পেঁয়াজ চাষ করেন। তিনি বলেন, “চাষাবাদ সহজ—বপন করো, বড় হলে বিক্রি করো, ব্যস।”
খনির পাশেই ঘোড়া ঘুরে বেড়ায়, আবার পাশেই চলতে থাকে বিরল খনিজের উত্তোলন। উন্নয়ন আর ধ্বংসের মাঝে আটকে থাকা এই জনপদের মানুষের জীবন এখন এক নতুন বাস্তবতা। সূত্র : বিবিসি
বিডিপ্রতিদিন/কবিরুল